
মো ফেরদৌস মোল্লা, পিরোজপুর জেলা প্রতিনিধি:-
এমন নির্মমতা বাংলাদেশ কখনো দেখেনি। এ এক নির্মমতার নতুন মাত্রা। একাত্তর থেকে মাত্র এক যুগ পরের ঘটনা। হ্যাঁ, আমি ১৯৮৪ এর ২৮ শে ফেব্রুয়ারির কথা বলছি। আমি শহীদ সেলিম ও দেলোয়ার এর কথা বলছি। পরাজিত পাকিস্তানী প্রেতাত্মার ভয়ানক রক্ত তৃষ্ণার এর নির্মম প্রকাশ ছিল সেলিম এবং দেলোয়ারের হত্যাকাণ্ড।
আর তার এই রক্ততৃষ্ণার প্রথম শিকার হয় ১৯৮৩ এর ১৪ ই ফেব্রুয়ারি জাফর, জয়নাল, কাঞ্চন, দীপালী সাহা, মোজাম্মেল এবং আইয়ুবসহ আরও দশ জন। হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ এর শিক্ষামন্ত্রী মজিদ খান এর প্রতিক্রিয়াশীল শিক্ষানীতি এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে প্রাণ দেন তাঁরা।
ঠিক তার পরের বছর ১৯৮৪ এর ২৮ ফেব্রুয়ারি আরও ভয়াবহতা নিয়ে জাতির সামনে হাজির হয়। ইয়াহিয়া, টিক্কা, নিয়াজি এর বশংবদ সেনা অফিসার এরশাদ এর রাষ্ট্রীয় পেটোয়া বাহিনী ছাত্র মিছিলে ট্রাক উঠিয়ে দিয়ে হত্যা করে ইব্রাহিম হোসেন সেলিম এবং কাজী দেলোয়ার হোসেনকে। দু’জনেই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী বাংলাদেশ ছাত্রলীগ এর কর্মী।
শিক্ষামন্ত্রী ডঃআব্দুল মজিদ খান এর মাধ্যমে শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে ব্যর্থ এরশাদ এর পর চেষ্টা করেন উপজেলা নির্বাচন করতে। প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের নামে আইনের মাধ্যমে উপজেলা নামক একধরণের স্থানীয় সরকার এবং প্রশাসনিক স্তর তৈরি করেন এরশাদ। এরপর ঘোষণা করেন উপজেলা পরিষদ এর নির্বাচন। এই সমস্ত উপজেলা চেয়ারম্যানরাই পরবর্তীতে ‘এরশাদীয় মৌলিক গণতন্ত্রী’ হয়ে উঠতেন কি না কে জানে।
আইয়ুব খান জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হওয়ার চেয়ে স্থানীয় পর্যায়ে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিতদের ভোটে নির্বাচিত হওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। যার নাম ছিল ‘মৌলিক গণতন্ত্র’। স্থানীয় পর্যায়ে এক ধরনের নির্বাচিত মাস্তানতন্ত্র কায়েম করে তৃণমূলের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করাই ছিল এর লক্ষ্য। এরশাদও একই পথ ধরেছিলেন বলেই মনে হয়। এরশাদের সতের জেলাকে চৌষট্টি জেলায় রূপান্তরও আইয়ুবের অসমাপ্ত কাজের সমাপ্তি বলেই অনেকে মনে করেন। তার উন্নয়ন উন্নয়ন খেলার সাথে আইয়ুব খানের ‘উন্নয়নের দশক’ এর মিল পাওয়া যায়।
১৯৫৮ সালে এরশাদ যখন তরুণ সামরিক কর্মকর্তা তখন আইয়ুব খান সামরিক শাসক ছিলেন।সুতরাং এরশাদ এর সামরিক শাসন সংক্রান্ত প্রাথমিক পাঠ ‘আইয়ুবীয় স্কুল’ এ হয়েছে এটা ধারণা করা অসঙ্গত হবেনা।
সেলিম এবং দেলোয়ার যে মিছিলে ছিলেন তা ছিল সেই উপজেলা পরিষদের নির্বাচন বাতিলের প্রতিবাদে। মিছিলটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন থেকে শুরু হয়ে কার্জন হল, বঙ্গবাজার হয়ে ফুলবাড়িয়ার দিকে অগ্রসর হয়। তখন বঙ্গবাজার ফায়ার ব্রিগেড অফিসের পাশ থেকে একটি পুলিশ ভ্যান ছাত্রদের মিছিলটিকে অনুসরণ করতে থাকে। সেলিম এবং দেলোয়ার ছিলেন মিছিলের পেছন দিকে। হঠাৎ পুলিশের গাড়িটি ছাত্রদের মিছিলে উঠে যায়। ঘটনাস্থলেই নিহত হন সেলিম এবং দেলোয়ার। আহত হন আরো কয়েকজন ছাত্র।
সেলিম এর জন্ম ১৯৫৪ সালে পটুয়াখালী’র বাউফল উপজেলা এর নাজিরপুর গ্রামে ।মৃত্যুর বছরে তিনি ছিলেন ইতিহাস বিভাগ এর চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। তখনকার একাডেমিক সিস্টেমে এম এ ক্লাশের ছাত্র। বাড়িতে ছিল তার ছয় মাস বয়েসি কন্যা সন্তান। আরেকটি বছর পার হলেই তার এম এ ডিগ্রি হয়ে যেত। জীবনের গতিমুখ অন্য দিকে হত। রাজনীতি কিংবা চাকরি যাই হোক না কেন, তার দেশ ভাবনার পাশাপাশি থাকতো তাঁর পরিবার।
নাহলে আজ এই দৃশ্য জাতিকে দেখতে হত না যে সেলিম এর কন্যা অর্থাভাবে ঠিকভাবে লেখাপড়া করতে পারেনি। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করে আবার বিরতি নিয়ে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং এইচএসসি পাশ করেছে। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী পদে চাকরী করছে সেলিম এর কন্যা ডরোথি।
যার বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল সেরকম কোন সন্তান চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী পদে চাকরি করা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্য। আমাদের জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে গিয়ে সেলিম তাঁর পরিবারকে অনেক পিছিয়ে দিয়েছেন। এই ঋণ শোধ হবার নয়।
কাজী দেলোয়ার হোসেন এর জন্ম ১৯৬২ সালে, পিরোজপুর জেলার ভাণ্ডারিয়া উপজেলার উত্তর পৈকখালী গ্রামে। পাঁচ ভাই এবং দুই বোনের মধ্যে চতুর্থ দেলোয়ার ছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। ট্রাক চাপা দিয়ে দেলোয়ারকে হত্যার পর হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তাঁদের পিরোজপুর এর বাড়িতে গিয়েছিলেন। দেলোয়ার এর পিতামাতাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ গ্রহণের জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু তাঁরা তা প্রত্যাখ্যান করেন। স্বৈরশাসক এরশাদ টাকা রেখে সেখান থেকে বিদায় হয়ে যান।