অনেক দিন পর গ্রামে আসলাম। সাধারণত শহর থেকে কেউ গ্রামে আসলে বন্ধুবান্ধব বা সিনিয়র জুনিয়র সবাই দেখা করতে আসে। আমিও সবার সাথে দেখা করতে যাই। আমি যখনই গ্রামগঞ্জে যাই । সবাই আমাকে নিয়ে আনন্দ উল্লাসে মতে উঠে। আমি একমাত্র শহর পড়ুয়া ছাত্র। সবাই আমাকে ভালোবাসে। আমিও তাদের জন্য শহর থেকে চকলেট, বাদাম, আচার নিয়ে যাই। আমাকে নিয়ে আমার বন্ধুবান্ধব এলাকায় তন্নতন্ন করে খুজে বেড়ায়। কার বাসায় কোন ফল গাছ, ওদের সব জানা আছে। আমিও মাঝে মাঝে ওদের সাথে যাই। আখ,লেবু ,আম,জাম, কাঠাল,লিচু,পেয়ারা,জম্বুরা ইত্যাদি ফল চুরি করে খুব মজা করে খাই। সব জায়গা ওরা চিনে।তাই বেশি কষ্ট করতে হয় না।যে ফল চুরি করে খাই, তার চেয়েও বেশি ফল আমাদের বাড়িতে আছে। তারপরও ওদের সাথে চুরি করতে খুব মজা পাচ্ছি। ওদের সাথে সারাদিন ঘুরে বেড়াই,বড় আনন্দ লাগে। একদিন তো আমাদের বাগানের ফল চুরি করে আমাকে খেতে দিছে। অনেক মজা পেয়েছি সেদিন । আমাদের বাগানের ফল খেয়ে এমন মজা কোনো দিন পাইনি। যে ছেলে চুরি করতে ভালো পারে, তার নাম সুমন।ছোটো,বড় সবাই সুমন কে বস নামে ডাকে। আমিও প্রথম প্রথম সুমন কে খুব ভয় পেতাম। ভয় পাওয়ার কারণে সবাই তাকে বস ডাকে। ডাকাত, সন্ত্রাস,গুরু, মাস্তানদের বস ডাকা হয়। আমিও বস বলে ডাক দিলাম। ছেলেটা সাথে সাথে কেদেঁ দিছে। আমি আরও ভয় পেলাম । সম্পূর্ণ শরীল ভয়ে থরথর করতে লাগল। কেদেঁ কেদেঁ এসে বললো। ভাই আপনি বস ডাকবেন না। আমি আপনার অনেক ছোট। আমি আপনার ৬ ব্যাচ জুনিয়র। আমার নাম নিয়ে ডাকবেন। আমি খুব লজ্জা পেলাম। সুমন খুব মেধাবী ছাত্র। পিএসসি জিপিএ ৫ পেয়েছে। এখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে। গ্রামের মেধাবী ছেলেদের মধ্য অনেক গুন থাকে। আমাকে দেখলেই ভাইয়া বলে ডাক দেয়। সুমনের কাছ থেকে ভাইয়া ডাক শুনতে খুব ভালো লাগে। সুমন সুন্দর সুন্দর গান ও জানে। মাঝে মাঝে পূনিমার রাতে গানের আড্ডা হয়। সুমনের বাসা আমাদের পাশের গ্রামে। সুমনের সাথে আমার পরিচয়,ফলটল চুরি করার মাধ্যমে। ওর ডাকের মধ্য মধু আছে। একদিন মায়নার বাসায় বেড়াতে গেলাম। ময়না আমার ফুফাতো বোন। বিয়ে হয়েছে। আমি বিয়েতে আসতে পারিনি। আমার উপর রাগ করে আছে। তাই ময়নার বাসায় যাওয়া।বাসায় ডুকার সাথে সাথে আমাকে ভাইয়া বলে ডাক দিলো। জানতে পারলাম ময়নার স্বামীর ভাই এর ছেলে। আমার মামা হয়। আমি মামা ডাকতে বললাম। সে মামা ডাকে না। এরকম অনেক হয়। আমরা অনেক সময় ভাইকে,ভাই ডাকি, ভাইয়ের ছেলেকেও ভাই ডাকি। এটি রাজনীতি যারা করে তাদের ক্ষেত্রে বেশি প্রযোজ্য। সাধারণত নেতাদের নাম ধরে ডাকা হয় না। ওমুক ভাই তমুক ভাই। নেতাকেও ভাই ডাকে। নেতার ছেলেকেও ভাই ডাকে। আমি তো রাজনৈতিক নেতা না। তারপরও আমাকে ভাই ডাকে। আমার লজ্জা লাগে। হাজারবার নিষেধ করছি কাজ হয় না। মামা, ভাই ডাকা আধুনিকতার ছোঁয়া নাকি প্রকৃতির নিয়ম ??
গ্রাম থেকে চলে আসলাম। ক্যাম্পাসের যাওয়ার জন্য রিকশা ডাক দিলাম। ওই মামা এদিকে আসো। কোথায় যাবেন? ক্যাম্পাসে যাবো।
আমিঃ যাবেন?
রিকশাচালকঃ হুম চলেন, আচ্ছা মামা একটা কথা জিগাইতাম?
আমিঃ হুম বলেন, চেহারায় মধ্য হাজারো অভিযোগের সাফ। মনে হচ্ছে হাজারো দিনের কষ্টের কথা শেয়ার করবে।
রিকশাচালকঃ আচ্ছা আপনারা আমাদের মামা ডাকেন কোনো?
ভাই ডাকলে কি হয়?
আমরা যারা রাস্তা ঘাটে কাজ করি। রিক্সা,ভ্যান,
বাস,চালায়। সবাই কে মামা ডাকেন কোনো?
আমিঃ আচ্ছা ঠিক আছে।আজ থেকে ভাই ডাকবো।
রিকশাচালকঃ না আপনি বললে হবে না।
আমি চুপ রইলাম।
রিকশাচালকঃ আপনারা আমাদের মামা ডেকে ,আলাদা একটা শ্রেণিতে ভাগ করে দিয়েছেন। তা কি সঠিক?
আমিঃ কিভাবে?
রিকশাচালকঃ আমরা যারা নিম্ন শ্রেণির পেশায় আছি।। তাদেরকেই আপনারা মামা ডাকেন,তার মানে আপনারা কি বোঝাতে চান?
আমিঃ আপনাদের মামা ডাকি, সমস্যা কি তাতে?
আমরা তো আপনাদের সন্মান করেই মামা ডাকি, তাই না?
রিকশাচালকঃ তাহলে আমরা আপনাদের কি বলবো? আমরা তো আপনাদের নাম জানিনা।
আমিঃ আপনারাও আমাদের মামা ডাকবেন । সমস্যা নেই। যতো খুশি ততবার মামা ডাকবেন।
রিকশাচালকঃ আপনাদের মামা ডাকবো, ঠিক আছে। কিন্তু আপনার বয়সী মেয়েদের কি নামে ডাকবো? তারাও তো আমাদের মামা ডাকে। তারা মামা ডাকলে, তাদের তো খালাম্মা ডাকতে হবে। তাদের যদি খালাম্মা ডাকি, তারা তো রাগ করে। আপনি বলেন, অল্প বয়সী মেয়েদের কি খালা ডাকা যায়?
আমাদের কাছে অল্প বয়সী মেয়েদের খালাম্মা ডাকতে খারাপ লাগে। তারপরও সেদিন এক মেয়ে আমাকে মামা বলে ডাক দিছে। আমি গেলাম। দেখি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। আমি বললাম কোথায় যাবেন? উত্তর দিলো না। আবার জিজ্ঞাসা করলাম খালাম্মা কোথায় যাবেন? আমার গালে এক থাপ্পড় মেরে দিলো। বলতাছে আমাকে কি আপনার খালা মনে হয়? আমার বয়স কত? অল্প বয়সী মেয়েদের খালা ডাকতে লজ্জা করে না।
রিকশাচালকঃ আপনিই বলেন অল্প বয়সী মেয়েরা আমাদের মামা ডাকলে,আমরা তাদের কি ডাকবো?
আপনারা তো আমাদের একটা শ্রেণিতে ভাগ করে দিছেন। নতুন একটা শ্রেণি তৈরি হয়েছে। তা হলাম আমরা। যারা নিম্ন শ্রেণির মানুষ। মানুষ আধুনিক হওয়ার সাথে সাথে আমরাও একটি শ্রেণিতে ভাগ হয়ে গেলাম। আমি যখন রিক্সা চালাই, আমার ছেলেকেও মামা ডাকেন। আমাকেও মামা ডাকেন।
যখন খাবার হোটেলে কাজ করি । আমাকে মামা ডাকেন। আমার ছেলেকেও মামা ডাকেন।
আচ্ছা, আপনারা তো শিক্ষিত মানুষ । একটা দোকান বা রেষ্টুরেন্টে বাপ, পুত্র কাজ করতে পারে না?
আমি উত্তর দিলাম। হ্যা, পারে। একটা হোটেলের সবাই কে আপনারা মামা ডাকেন কিভাবে?
আমি তার কথার উত্তর না দিতে পেরে, পরাজিত কন্ঠ বললাম আর এ রাখেন রাখেন। ক্যাম্পাসে চলে আসলাম।
আমাকে এখানে নামিয়ে দিন। রিক্সা থেকে নামে চলে গেলাম।
লেখকঃ মো.সুরুজ খাঁন শুভ,বশেমুরবিপ্রবি