ফারদিন মোহাম্মদ :
পটভূমি :
আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে কুরাইশদের এক বিরাট কাফেলা সিরিয়া থেকে প্রত্যাবর্তনকালে মুসলিম অধিকৃত এলাকার কাছাকাছি এসে পৌঁছলো। কাফেলার সঙ্গে প্রায় ৫০ হাজার আশরাফী মূল্যের ধন-মাল এবং ৪০জনের তত্ত্বাবধায়ক ছিল। তাদের ভয় ছিল, মদিনার নিকটে পৌঁছলে মুসলমানরা হয়ত তাদের ওপর হামলা করে বসতে পারে। কাফেলার নেতা আবু সুফিয়ান এই বিপদাশংকা উপলব্ধি করেই এক ব্যক্তিকে সাহায্যের জন্যে মক্কায় পাঠিয়ে দিল। ঐ লোকটি মক্কায় পৌঁছেই এই বলে শোরগোল শুরু করলো যে, তাদের কাফেলার ওপর মুসলমানরা লুটতরাজ চালাচ্ছে। সুতরাং সাহায্যের জন্যে সবাই ছুটে চলো। কাফেলার সঙ্গে যে ধন-মাল ছিল, তার সাথে বহু লোকের স্বার্থ জড়িত ছিল। ফলে এ একটা জাতীয় সমস্যায় পরিণত হলো। তাই সাহায্যের ডাকে সাড়া দিয়ে কুরাইশদের বড় বড় সর্দারই যুদ্ধের জন্যে বেরিয়ে পড়লো। এভাবে প্রায় এক হাজার যোদ্ধার এক বিরাট বাহিনী তৈরি হয়ে গেল।এই বাহিনী অত্যন্ত উৎসাহ-উদ্দীপনা ও শান-শওকতের সঙ্গে মক্কা থেকে যাত্রা করলো। এদের হৃদয়ে একমাত্র সংকল্প :মুসলমানদের অস্তিত্ব এবার নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে হবে, যেন নিত্যকার এই ঝঞ্ঝাট চিরতরে মিটে যায়। বস্তত ,একদিকে তাদের ধন-মাল রক্ষার আগ্রহ , অন্যদিকে পুরনো দুশমনি ও বিদ্বেষের তাড়না – এই দ্বিবিধ ক্রোধ ও উন্মাদনার সঙ্গে কুরাইশ বাহিনী মদিনা আক্রমনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলো।
ঐতিহাসিক ঘটনা :
বদর যুদ্ধে মুসলমানগণ ছিলেন কাফেরদের থেকে তুলনামুলকভাবে দুর্বল। কিন্তু মুসলমানদের ঈমানী শক্তির কাছে তাদের শক্তি কিছুই না। মুসলিম পক্ষে ছিল মাত্র ৩১৩ জন, অপরপক্ষে কাফেরদের সংখ্যা ছিল এক হাজারের অধিক। মুসলমানদের ৩১৩ জন সাহাবির মধ্যে ৮৫ জন ছিলেন মুহাজির সাহাবি; বাকি সবাই ছিলেন মদিনার আনসার। আনসারদের মধ্যে ৬১ জন আউস গোত্রের আর বাকি ৬৯ জন ছিলেন খাজরাজ গোত্রের। পুরো ৩১৩ জনের দলে উট ছিল ৭০টি আর ঘোড়া ছিল মাত্র দু’টি।
অপরদিকে কাফেরদের এক হাজারের দলের ৬০০ জনের কাছে ছিল দেহ রক্ষাকারী বর্ম এবং তাদের কাছে ঘোড়া ছিল ২০০টি। যুদ্ধক্ষেত্রটিতে মুসলমানেরা যে স্থানটিতে অবস্থান নিয়েছিলেন সেখানে সূর্যের তেজ সরাসরি তাদের মুখের ওপরে পড়ে। কিন্তু কাফেরদের মুখে দিনের বেলায় সূর্যের আলো পড়ে না। মুসলমানেরা যেখানে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করবেন সেখানের মাটি একটু নরম, যা যুদ্ধেক্ষেত্রের জন্য উপযুক্ত নয়। অপর দিকে কাফেররা যেখানে অবস্থান নিয়েছিলো সেখানের মাটি শক্ত এবং যুদ্ধের জন্য স্থানটি ছিলো উপযুক্ত।
এহেন সঙ্কুল পরিস্থিতিতে বদর যুদ্ধের প্রাক্কালে আল্লাহ কাফিরদের যুদ্ধের প্রস্ততি ও প্রত্যয় উল্লেখ করে মুসলমানদের মনোবল বৃদ্ধির জন্য যুদ্ধের পরিনতির কথা জানিয়ে দিয়ে বলেন,
নিঃসন্দেহে যেসব লোক কাফের, তারা এমন পথে নিজেদের ধন-সম্পদ ব্যয় করে যাতে করে আল্লাহর পথে বাধাদান করতে পারে। বস্তুতঃ এখন তারা আরো ব্যয় করবে। তারপর তা তাদের জন্য আক্ষেপের কারণ হবে এবং শেষ পর্যন্ত তারা হেরে যাবে। (সুরা আনফাল : আয়াত ৩৬)
এরপেই শুরু হয় বদরের লড়াই। মুসলমানরা মহান আল্লাহর উপর ভরসা করে বীর বীক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়েন কাফিরদের উপর। যুদ্ধ শুরু হবার পরে যখন যুদ্ধের তীব্রতা ভয়াবহ পর্যায়ে গেল সেসময় হজরত আবু বকর (রা.) দেখতে পেলেন, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাঁদছেন, আর আল্লাহর দরবারে বলছেন :
‘হে আল্লাহ! হাতেগোনা মুসলমানদের এই ছোট্ট দলটি যদি আজ শেষ হয়ে যায়, তাহলে এই দুনিয়ার বুকে ইবাদতের জন্য আর কেউ অবশিষ্ট থাকবে না। সুতরাং হে আল্লাহ! আপনি আপনার সেই সাহায্য অবতরণ করুন, যা দেয়ার অঙ্গীকার আপনি আমার সঙ্গে করেছেন।’ (বুখারী)
রাসূল সা. এর এই দোয়ার পরেই মহান আল্লাহ মুসলমানদের সান্তনা এবং সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আয়াত নাযিল করে বলেন-
‘যখন তোমরা তোমাদের পালনকর্তার নিকটে কাতর প্রার্থনা করছিলে, তখন তিনি তোমাদের দো‘আ কবুল করলেন। আমি তোমাদেরকে সাহায্য করব এক হাজার ফেরেশতা দ্বারা, যারা হবে ধারাবাহিক ভাবে অবতরণকারী’। (সুরা আনফাল: আয়াত ৯)
যখন তোমাদের পরওয়ারদেগার নির্দেশ দান করেন ফেরেশতাদেরকে যে, আমি সাথে রয়েছি তোমাদের, সুতরাং তোমরা মুসলমানদের চিত্তসমূহকে ধীরস্থির করে রাখ। অচিরেই আমি কাফেরদের মনে ভীতির সঞ্চার করে দেব’। (সুরা আনফাল :আয়াত ১২)
অতঃপর যুদ্ধে মহান আল্লাহ’র প্রতিশ্রুত সাহায্য আসে এবং মুসলমানদের বিজয়ের মাধ্যমে বদরের যুদ্ধ সমাপ্ত হয়।
ফলাফল :
এই যুদ্ধে মুসলিম পক্ষে ৬জন মুহাজির ও ৮ জন আনছার অর্থাৎ ১৪ জন শহীদ হন। অন্যদিকে কাফেরদের পক্ষের ৭০ জন নিহত ও ৭০ জন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি বন্দী হয়। তাদের বড় বড় ২৪ জন নেতাকে বদরের একটি পরিত্যক্ত দুর্গন্ধময় কূপে নিক্ষেপ করা হয়। হিজরতের প্রাক্কালে মক্কায় রাসূল (সা.) কে হত্যার ষড়যন্ত্রকারী আবু জাহল সহ ১৪ নেতার ১১ জন এই যুদ্ধে নিহত হয়। বাকী তিনজন আবু সুফিয়ান, জুবায়ের বিন মুতব‘ইম ও হাকীম বিন হেযাম পরে মুসলমান হন। এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে মক্কা বিজয়ের হয় এবং বদর যুদ্ধের উদ্দেশ্য পূর্ণতা লাভ করে।
অলৌকিক এই বিজয়ের ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে :
তোমরা (মুসলমানরা) তাদেরকে হত্যা করনি; বরং আল্লাহই তাদের হত্যা করেছেন’। (সূরা আনফাল : আয়াত ১৭)
নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করেছেন বদরের যুদ্ধে। অথচ তোমরা ছিলে দুর্বল। অতএব আল্লাহকে ভয় কর যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হতে পার’। (সুরা আলে ইমরান: আয়াত ১২৩)
বদরের যুদ্ধের সবচেয়ে বড় শিক্ষণীয় বিষয় হল সব কিছুর জন্য সবার উপরে মহান আল্লাহর ওপর ভরসা বা তাওয়াক্কুল করা। এই যুদ্ধ প্রমান করে সংখ্যা ও যুদ্ধ সরঞ্জামের কমবেশী বিজয়ের মাপকাঠি নয়, বরং আল্লাহর উপরে দৃঢ় ঈমান ও তাওয়াক্কুল হল বিজয়ের মূল হাতিয়ার।