কোনও আগ্নেয়াস্ত্র কিংবা ধারালো অস্ত্রের ব্যবহার নয়; বরং কিল-ঘুষি, বাঁশের লাঠির আঘাত এবং পাথর নিক্ষেপের মিশেলে রক্তক্ষয়ী এক সংঘর্ষ। কয়েক ঘণ্টার এই সংঘর্ষে প্রাণ যায় প্রায় দুই ডজন সেনা সদস্যের। রক্তাক্ত এই সংঘর্ষ হয়েছে ভারত এবং চীনের সেনাবাহিনীর সদস্যদের মধ্যে; লাদাখ অঞ্চলের বিতর্কিত সীমান্তে। সোমবার রাতে। নিহত সৈন্যরা ভারতের।
তবে নয়াদিল্লির দাবি চীনেরও অন্তত ৪৩ সৈন্য হতাহত হয়েছে। চীন নিজ দেশের সৈন্য হতাহতের ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও তথ্য জানায়নি। হিমালয় অঞ্চলের বিতর্কিত লাদাখ সীমান্তের সংঘর্ষের নতুন নতুন তথ্য সামনে আসছে।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি বলছে, লাদাখের ওই সংঘর্ষের সময় চীনের ৩০০ ও ভারতের ৫৫ সেনা সদস্য উপস্থিত ছিল। চীনা সৈন্যদের এই বহরকে ‘ডেথ স্কোয়াড’ হিসেবে মন্তব্য করেছেন ভারতের সামরিক বিশ্লেষকরা।
ভারতের সামরিক বাহিনীর জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেন, সেখানে চীনা ৩০০ সৈন্যের বিপরীতে ভারতের ৫৫ সৈন্য লড়াই করেছেন। চীনা সৈন্যরা দেশটির ডেথ স্কোয়াডের সদস্য বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এই কর্মকর্তা বলেন, তারা তারে মোড়ানো ধাতব লাঠি দিয়ে আমাদের ছেলেদের মাথায় আঘাত করেছে। আমাদের ছেলেরা শূন্য হাতে লড়াই করেছে। ভারতীয় এই সেনা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি বলে জানিয়েছে বিবিসি। তবে তার এই মন্তব্যের সত্যতাও যাচাই করা যায়নি।
এদিকে, পারমাণবিক অস্ত্রধারী প্রতিবেশি দুই দেশের সৈন্যদের মাঝে এই সংঘাতের ঘটনায় আবারও উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। দেশের ভেতরে চাপের মুখে পড়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বিরোধীরা তীব্র কটাক্ষ করে সৈন্যদের প্রাণহানির জবাব মোদির কাছে চেয়েছেন।
দেশটির প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের জ্যেষ্ঠ নেতা রাহুল গান্ধী এক টুইট বার্তায় লিখেছেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নীরব কেন? তিনি কেন লুকিয়েছেন? রাহুল গান্ধী বলেছেন, যথেষ্ঠ হয়েছে। কি ঘটেছে সেটা আমাদের জানা দরকার। কত বড় দুঃসাহস চীন আমাদের সৈন্যদের হত্যা করছে? তারা আমাদের ভূখণ্ড দখল করার দুঃসাহস কীভাবে দেখায়?
ক্রমেই অবনতিশীল করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবিলা নিয়ে ইতোমধ্যে দেশের ভেতরে ব্যাপক সমালোচনার মুখে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এই ভাইরাসে দেশটিতে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩ লাখ ৫৪ হাজার মানুষ আক্রান্ত এবং ১২ হাজার মানুষ মারা গেছেন। করোনার বিস্তারের লাগাম টানতে দেশটির বেশ কিছু রাজ্য লকডাউনের মেয়াদ বৃদ্ধি করেছে। করোনার প্রকোপ বাড়তে থাকায় দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা দ্রুত ভেঙে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ভারতের শীর্ষ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
এমন পরিস্থিতিতে চিরবৈরী প্রতিবেশি চীনের সঙ্গে সংঘাতে ভারতীয় সৈন্যদের প্রাণহানির ঘটনা আরও চাপে ফেলেছে মোদি সরকারকে। কাউন্সিল অন ফরেইন রিলেশনের দক্ষিণ এশিয়া, ভারত এবং পাকিস্তানবিষয়ক জ্যেষ্ঠ ফেলো অ্যালিসা আয়রেস বলেন, সময়টা চারদিক থেকেই ভয়ঙ্কর।
‘ভারত আগে থেকেই অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে পড়েছে; করোনাভাইরাস লকডাউন সেই পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তুলেছে। ধীরে ধীরে করোনা সংক্রমণ বাড়ছে; যা দেশটির জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার ওপর চাপ বৃদ্ধি করবে।’ তিনি বলেন, এর মাঝে তিনটি দেশের সঙ্গে সীমান্ত সমস্যা তৈরি হয়েছে; নেপাল, পাকিস্তান এবং চীন।
সোমবার রাতে লাদাখ সীমান্তে চীনা ও ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে সংঘর্ষ হলেও এ ব্যাপারে প্রথমবারের মতো নীরবতা ভেঙে প্রধানমন্ত্রী মোদি কথা বলেছেন বুধবার। হিমালয় অঞ্চলের লাদাখে বিতর্কিত সীমান্তে চীনা সৈন্যদের সঙ্গে সংঘর্ষে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর ২০ সদস্যের প্রাণহানি বৃথা যাবে না বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
এদিকে, গত শনিবার ভারতের সঙ্গে বিতর্কিত তিন ভূখণ্ড নিজেদের মানচিত্রে যুক্ত করে নতুন একটি মানচিত্র পাস হয় নেপালের পার্লামেন্টে। নেপালের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদে নতুন মানচিত্র অনুমোদনে আনা সংবিধান সংশোধনী বিল ভোটাভুটিতে পাস হয়ে যায়। নয়াদিল্লির আপত্তি উড়িয়ে নেপালের নতুন এই মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বিতর্কিত লিম্পিয়াধুরা, কালাপানি ও লিপুলেখ ভূখণ্ডকে।
নেপালের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য সংখ্যা ২৭৫ জন। নতুন রাজনৈতিক মানচিত্রে অনুমোদন দেয়া সংবিধান সংশোধনী বিলটি পাসের জন্য প্রয়োজন ছিল দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন। শাসকদল নেপাল কমিউনিস্ট পার্টির পাশাপাশি প্রধান বিরোধী দল নেপালি কংগ্রেস এমনকি, ভারতীয় বংশোদ্ভূত নেপালি দলগুলোও বিলটি সমর্থন করেছে।
ভারতীয় বিশ্লেষকরা নেপালের নতুন এই মানচিত্র তৈরি ও পার্লামেন্টে পাসের ঘটনায় চীনের সমর্থন রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন। এমনকি ভারতের সেনাবাহিনীর প্রধানও নেপালের সঙ্গে উত্তেজনায় তৃতীয় পক্ষের মদদ রয়েছে বলে জানিয়েছেন। তবে এই তৃতীয় পক্ষ বলতে কোন দেশকে বুঝিয়েছেন সেব্যাপারে পরিষ্কার কোনও তথ্য দেননি তিনি।