শেষ ওভারে জয়ের জন্য দরকার ৭ রান। বোলিংয়ে জেসন গিলেস্পি। ব্যাট হাতে প্রস্তুত আফতাব আহমেদ। এতটুকু বললেই বুঝে ফেলার কথা কোন ম্যাচের কথা বলা হচ্ছে। বাকিটা তো স্মৃতির পাতায় এখনো জীবন্ত!
স্লোয়ারটা একটু সামনেই ফেলেছিলেন গিলেস্পি। ওটাই হয়তো বড় ভুল। আফতাব স্টাম্প ঢেকে জায়গা বানিয়ে বলটা ভাসালেন বাতাসে। মিড উইকেট দিয়ে বিশাল ছক্কা। ডেভিড লয়েডের কণ্ঠে উত্তেজনা ‘দ্যাটস সিক্স, দ্যাটস আউট অফ হেয়ার। অল দ্য ওয়ে…বাংলাদেশ ইউ আর হোম।’
২০০৫, কার্ডিফ। অথচ এখনো মনে হয় গতকালের ঘটনা! সারাজীবন কি এমনই মনে হবে! অন্তত বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে, ম্যাচটা দেখেছিলেন যাঁরা তাঁদের কাছে?
একটা জয়ের জন্য তখন হাপিত্যেস করতে হতো বাংলাদেশকে। হাবিবুল বাশারদের যে কোনো জয়ে ঢাকার রাজপথে নেমে পড়তো আনন্দ শোভাযাত্রা। সেখানে ইংল্যান্ডের মাটিতে তখনকার চ্যাম্পিয়ন রিকি পন্টিংয়ের ‘অজেয়’ অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর অনুভূতি বোঝাতে শব্দের ঝুলিতে টান পড়বেই।
সোফিয়া গার্ডেনসের উইকেট সেদিন শুরুতে বোলারদের পক্ষে ছিল। অস্ট্রেলিয়ান অহম থেকেই ব্যাটিং নিয়েছিলেন পন্টিং। প্রতিপক্ষ তো বাংলাদেশ! ব্যাটসম্যান ও বোলারদের র্যাঙ্কিংয়ে তাঁদের খুঁজে পাওয়া কঠিন। অন্যদিকে র্যাঙ্কিংয়ের সর্বত্র রাজত্ব চলছিল অস্ট্রেলিয়ানদের। কিন্তু ক্রিকেট যে গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা সেটি কি ভুলে গিয়েছিল পন্টিংয়ের দল!
ন্যাটওয়েস্ট ট্রফির সে ম্যাচে ওই অনিশ্চয়তাটুকুর আভাস মিলেছিল দিনের শুরুতেই। দ্বিতীয় বলে অ্যাডাম গিলক্রিস্টকে এলবিডব্লিউয়ের ফাঁদে ফেলেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। নাজমুল হোসেন ও তাপস বৈশ্য মিলে ১৫.৪ ওভারের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার আরও ২ উইকেট (৫৭ রান) ফেলে চাপটা বাড়ান। তবু মাইকেল ক্লার্ক ফিফটি তুলে নেওয়ায় অস্ট্রেলিয়ার সংগ্রহ দাঁড়ায় ৫ উইকেটে ২৪৯।
এখনকার দিন হলে বলা যেত, সংগ্রহটা সাদাটামাটা কিংবা মেরেকেটে মাঝারি। কিন্তু ১৫ বছর আগের সেই দিনে গ্লেন ম্যাকগ্রা, গিলেস্পি, মাইকেল কাসপ্রোউইচ ও ব্র্যাড হগদের নিয়ে সাজানো অস্ট্রেলিয়ার বোলিং আক্রমণের সামনে এই লক্ষ্য তাড়া করা সহজ ছিল না অনভিজ্ঞ বাংলাদেশের জন্য। ওই ২৪৯–ই বাংলাদেশের জন্য ছিল তিনশ’র সমান । শুধু একজন বাদে।
নাহ, আফতাব নন, মোহাম্মদ আশরাফুল। ত্রিদেশীয় সিরিজ জুড়েই ইংল্যান্ডের ‘ট্রু বাউন্স’ উইকেটে হার্মিসন, ফ্লিনটফদের দুর্দান্ত সব পুল-হুক করে দৃষ্টি কেড়েছিলেন আশরাফুল। কার্ডিফে ম্যাচ জেতানো সেঞ্চুরি করে তো অমরত্বই পেয়ে যান দেশের ক্রিকেটমোদীদের কাছে! মাঝে ফিক্সিং কান্ডে আশরাফুল হয়তো কলঙ্কিত করেছেন নিজেকে, তাই বলে তাঁর সেদিনের সেই ইনিংস বাংলাদেশের ক্রিকেট অ্যালবাম থেকে মলিন হয়ে যায়নি।
১১ চারে ১০১ বলে ১০০ রান। জয়ের জন্য ১৮ বলে ২৩ রানের দূরত্বে থাকতে আউট হন আশরাফুল। ম্যাচ না জিতিয়ে আসার আক্ষেপ তাঁর ছিল। তবে অসম্ভবকে সম্ভব করে দলকে জয়ের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনিই। ৫১ রানে ২ উইকেট পড়ার পর ব্যাটিংয়ে নেমে চতুর্থ উইকেটে হাবিবুল বাশারের সঙ্গে ১৩৯ বলে ১৩০ রানের জুটি। পরে হাবিবুল জানান, আশরাফুলের সঙ্গে ব্যাটিংয়ের সময়ই জয়ের স্বপ্নটা আঁকা হয়ে যায় তাঁর মনে।
৪৩.৫ ওভারে দলীয় ২০২ রানে রান আউট হন হাবিবুল। তখন আশরাফুল একটু মন্থর হয়ে যান। বোঝাই যাচ্ছিল, কৌশলটা হলো অন্য প্রান্তের ব্যাটসম্যানেরা রান বাড়াবেন। আশরাফুল এক প্রান্ত ধরে রেখে ব্যাট করবেন জয় ছিনিয়ে আনা পর্যন্ত। মাইকেল ক্লার্ক ও ব্র্যাড হগের স্পিনও কী দারুণ দক্ষতায় খেলেছিলেন আশরাফুল! ইনসাইড আউট, লেট কাট থেকে সুইপ, প্রায় সব শটই ছিল ব্যাটে। ম্যাকগ্রার লো ফুলটস বলে ১ রান নিয়ে পেয়ে যান সেঞ্চুরি। মেহরাব হোসেনের পর বাংলাদেশের পক্ষে দ্বিতীয় ওয়ানডে সেঞ্চুরি।
আশরাফুলের পিঠে অভিবাদনের স্পর্শ বুলিয়ে যান পন্টিং। উইকেটের পেছনে দাঁড়ানো গিলি করতালি দিয়ে অভিনন্দন জানান। গ্যালারিতে প্রচুর সমর্থক তখন জয়ের নেশায় মাতোয়ারা। সুবাস আসছে, কিন্তু কখন ধরা দেবে জয়! ঠিক এমন মুহূর্তেই আশরাফুল আবারও সেই বুক কাঁপানো ‘চেনা’ ছন্দে! উইকেটে থাকলে এমনিতেই জয় আসত, কিন্তু তা না করে সেঞ্চুরির পরের বলেই তুলে মারলেন গিলেস্পিকে। আউট!
মোহাম্মদ রফিক নেমে প্রথম বলেই বাউন্ডারি গিলেস্পিকে। ওই ওভারে আফতাবের ব্যাট থেকে আসে আরও একটি চার। শেষ দুই ওভারে দরকার ১৩ রান। ৪৯তম ওভারে ম্যাকগ্রার দ্বিতীয় বলে রফিকের বাউন্ডারিটি এলো দমবন্ধ পরিস্থিতিতে এক পশলা অক্সিজেনের মতো।
শেষ ওভারে আফতাবের হিসেব-নিকেশ খুব সহজ ছিল। পেসাররা বল করলে মিড উইকেট সীমানায় ফিল্ডারদের রাখার নজির তেমন দেখা যায় না। কিন্তু সেদিন তা দেখে নিজের ক্রিকেটীয় বুদ্ধি দিয়েই আফতাব বুঝে নিয়েছিলেন, স্লোয়ার আসতে পারে! ব্যাটসম্যান যেন টেনে মারতে গিয়ে তুলে দেন, এই ছিল গিলেস্পির ফন্দি।
আফতাব টেনে মেরেছিলেন ঠিকই। কিন্তু গিলেস্পির হয়তো ধারণাই ছিল না আফতাবের টাইমিং সম্পর্কে। টের পেলেন যখন, ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে অনেক। আফতাবের ছক্কাটা দেখার পর মাথা নিচু করে নখ খুঁটছিলেন অধিনায়ক পন্টিং। মুখে ম্লান হাসি। যেন বিশ্বাসই হচ্ছিল না যা দেখলেন! ক্রিকেট ইতিহাসেরই অন্যতম বড় এক অঘটনের শিকার তাঁর ‘অজেয়’ দল।
আর আফতাব? আশরাফুল অবিস্মরণীয় ইনিংস খেললেও আফতাবের ওই ছক্কাই তো ছিল ‘উইনিং শট!’ পরের বলে জয় নিশ্চিত করা আফতাবের জন্য ১ রান নেওয়া ছিল শুধুই আনুষ্ঠানিকতা।
কার্ডিফের সে জয় বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটমোদীদের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে সবসময়। এত বেশি রান তাড়া করে শীর্ষ কোনো টেস্ট খেলুড়ে দেশের বিপক্ষে জয় পাওয়ার অভিজ্ঞতা যে সেদিনের আগে বাংলাদেশের ছিলই না! ওয়ানডেতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে আজও সেটিই বাংলাদেশের একমাত্র জয়। এমন একটা অর্জন কী ভোলা সম্ভব অন্তত আজকের দিনে? ঠিকই ধরেছেন। ১৫ বছর আগের সেই ‘কার্ডিফ রুপকথা’র জন্ম এই ১৮–ই জুনেই।