মুজাহিদ হোসেন, নওগাঁ জেলা প্রতিনিধি//
নওগাঁয় চলছে মাসব্যাপী তাঁত, বস্ত্র ও ক্ষুদ্র কুঠির শিল্প মেলা। মেলা চলছে শহরে আর লোভনীয় প্রচার মাইকিং করে সকাল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত লটারির টিকেট বিক্রি করা হচ্ছে শহর, মফস্বল ও প্রতিটি গ্রামের অলিগলিতে। মেলার অন্যতম আয়ের উৎসই হচ্ছে লটারির টিকেট বিক্রি।
এই আধুনিক জুয়ার ফাঁদে পড়ে জেলার ১১টি উপজেলা ও তার আশেপাশের স্থানীয় মানুষ বিশেষ করে দিনমজুর ও খেটে খাওয়া মানুষরা পুরস্কার পাওয়ার লোভের ফাঁদে পড়ে আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। অপরদিকে প্রতিদিনই অভিযোগের ভিত্তিতে বিভিন্ন উপজেলায় প্রশাসন ভ্রাম্যমাণ আদালতের আওতায় এনে টিকেট জব্দ ও জরিমানা আদায় করলেও থামছে না এই লটারির টিকেট বিক্রি।
নওগাঁ পৌরসভার রজাকপুর এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা জননেতা আব্দুল জলিল ট্রাক ও সিএনজি টার্মিনাল মাঠে নওগাঁ জেলা ট্রাক মালিক গ্রুপ ও সিএনজি মালিক সমিতির আয়োজনে গত ১৬ মে থেকে শুরু হয় এই মেলা। মেলা প্রাঙ্গনে বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীর অর্ধশতাধিক দোকান রয়েছে। এ ছাড়া শিশুদের বিনোদনের জন্য রয়েছে মিনি শিশুপার্ক ও সার্কাস। তবে মেলার প্রধান আকর্ষনই হচ্ছে লটারি। সকাল ৯টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ২০০ শতাধিক ইজিবাইকে মাইক লাগিয়ে গ্রামেগঞ্জে ঘুরে ঘুরে প্রবেশ টিকেটের নাম দিয়ে ২০টাকা মূল্যের ‘লটারির টিকেট’ বিক্রি করা হচ্ছে। রাত ১১টা থেকে প্রতি রাতে লটারির ড্র অনুষ্ঠিত হয়। মোটরসাইকেলসহ ৪০ থেকে ৪৫টি পুরষ্কার দেওয়া হচ্ছে প্রতিদিন। নওগাঁ জেলা ট্রাক মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক শেখ ফরিদ উদ্দিন সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করছেন।
মাসব্যাপী চলা এ মেলায় প্রতিদিন প্রবেশ টিকেটে র্যাফল ড্র’র নামে চলছে লটারি-বাণিজ্য। শুধু মেলা প্রাঙ্গণ নয়; এ টিকিট মাইকিং করে বিক্রি হচ্ছে জেলার বিভিন্ন স্থানে। এছাড়া পাশের জেলা বগুড়ার সান্তাহার পৌরসভা ও এর আশপাশের এলাকাতেও মাইকিং করে টিকিট বিক্রি করা হচ্ছে। পুরস্কারের মোহে আগপিছ না ভেবে হুমড়ি খেয়ে টিকিট কিনে নিঃস্ব হচ্ছে স্থানীয় লোকজন। এদিকে মেলায় লটারির নামে জুয়া বন্ধ ও স্থানীয় ক্যাবল টিভিতে লটারির ড্র অনুষ্ঠান বন্ধের দাবিতে সম্প্রতি ‘নওগাঁর সাধারণ জনগণ’ ব্যানারে জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ের সামনে শহরের প্রধান সড়কে মানববন্ধন কর্মসূচিও পালন করেছে।
রাণীনগর উপজেলার বিভিন্ন এলাকার কয়েকজন মানুষ বলেন, তাঁত, বস্ত্র ও ক্ষুদ্র কুঠির শিল্প মেলার নামে লটারির টিকেট বিক্রি করে গরিব মানুষের পকেট খালি করা হচ্ছে। মেলা হচ্ছে জেলা শহরে, কিন্তু টিকেট বিক্রি হচ্ছে জেলার বিভিন্ন উপজেলার গ্রামে-গঞ্জে। গ্রামের সহজ-সরল খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ বিশেষ করে গৃহবধূরা পুরস্কার পাওয়ার লোভে দেদারছে টিকেট কিনছেন। এর ফলে সামাজিক বিশৃঙ্খলা মারাত্মক রূপ নিয়েছে।
উপজেলার খট্টেশ্বর গ্রামের বাসিন্দা মামুনুর রশিদ বলেন অনেক দিনমজুররা দিন শেষে কাজ করে যে মজুরী পাচ্ছেন লোভে পড়ে তার সবটুকু টাকা দিয়েই কিনছেন লটারীর টিকেট। আর বাজারের অভাবে বাড়িতে না খেয়ে থাকতে হচ্ছে অন্য সদস্যদের। এতে করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক ভাবে অবনতি ঘটছে। নওগাঁর স্থানীয় কেবল টিভিতে প্রতি রাতে লটারির নামে ‘জুয়া খেলা’র ড্র সরাসরি সম্প্রচার করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে একটি মহল কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। আমরা দ্রুত মেলার নামে চলা দরিদ্রদের আরো দরিদ্র করার নামে আধুনিক পদ্ধতির এই জুয়ার বন্ধ চাই।
রাণীনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহাদাত হুসেইন বলেন, লটারির টিকেট বিক্রি বন্ধে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে চিঠি পাওয়ার পর থেকেই আমি বিভিন্ন সময় লটারি বিক্রির গাড়িতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে টিকেট জব্দ করার পাশাপাশি জরিমানাও আদায় করছি কিন্তু পুরোপুরো টিকেট বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। এই টিকেটের ফাঁদে পড়ে প্রতিদিনই শত শত মানুষ নি:স্ব হচ্ছেন। পুরস্কার হয়তো একজন পাচ্ছেন আর নি:স্ব হচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। নি:স্ব হওয়া এই মানুষদের বেশির ভাগই হচ্ছে গ্রামের গৃহবধূ, দিনমজুর ও খেটে খাওয়া শ্রেণির মানুষরা। এর জন্য শুধু প্রশাসন নয় পুলিশ প্রশাসনসহ সমাজের সকল স্তরের মানুষদের এগিয়ে আসতে হবে। তা না হলে এই জুয়ার টিকেট বিক্রি বন্ধ করা সম্ভব হবে না। যতদিন টিকেট বিক্রি হবে ততদিন আমার এই অভিযান অব্যাহত থাকবে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে শেখ ফরিদ উদ্দিন বলেন, সম্প্রতি জেলা প্রশাসন ট্রাক ও সিএনজি টার্মিনালের জন্য শহরের রজাকপুর এলাকায় জমি দিয়েছেন। সেই টার্মিনালের উন্নয়নের জন্য প্রশাসনের অনুমোদন নিয়ে এই মেলার আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়া প্রবেশ টিকেটের বিনিময়ে মানুষকে মেলায় আসতে আকৃষ্ট করতে লটারির আয়োজন করা হয়েছে। মেলা থেকে যা আয় হবে, সেটা দিয়ে টার্মিনালের উন্নয়ন করা হবে। তাই এই লটারির ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর করোনা ভাইরাসের কারণে একস্থানে লোকের জটলা না করতেই গাড়ি করে এই মেলার প্রবেশ মূল্যের টিকেটটি বিক্রি করা হচ্ছে।
জেলা প্রশাসক খালিদ মেহেদী হাসান বলেন, প্রশাসন বাণিজ্য মেলার অনুমোদন দিয়েছে। র্যাফল ড্রর অনুমোদন দেয়নি। লটারি কিংবা র্যাফল ড্র বিক্রির খবর আসার পর আমরা আয়োজকদের ইতোমধ্যে জানিয়েছি যে এটা অবৈধ এবং লটারি বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে। তারপরেও লটারির নামে টিকেট বিক্রির করার অপরাধে প্রশাসনের একাধিক ভ্রাম্যমাণ টিমও কাজ করছে। জনগণ ক্ষতিগ্রস্থ হয়, এমন ধরণের কর্মকান্ড চলতে দেওয়া হবে না।