মুজাহিদ হোসেন, নওগাঁ জেলা প্রতিনিধি//
বাজারে দেশি প্রজাতির চিতল, বোয়াল, শিং ও বাইন মাছের দেখা মেলে কালেভদ্রে। এখন বাজারে গেলে পাওয়া যায় না পাবদা, খলিশা, গজার, বেলে, রয়না, ফলই, চান্দা ও পুঁটি মাছ। এসব মাছ খেতে হলে তা খুঁজে বেড়াতে হয়। নতুন প্রজন্মের কাছে এসব মাছের প্রাচুর্য ও স্বাদ কেবলই গল্প। পরিবারে ৪০ বছর বয়সের ওপরে যারা আছেন, তারা দেশি এসব মাছের স্বাদ-গন্ধ মনে গেঁথে রেখেছেন। ফলে খাবার টেবিলে বর্তমানের চাষের পুঁটির সঙ্গে তুলনায় চলে আসে খাল-বিল, পুকুর, ডোবায় এমনি এমনি বেড়ে ওঠা পুঁটির স্বাদের কথা। এখন কত বড় বড় কই মাছ!
মাছ আমাদের খাদ্য তালিকায় অত্যাবশ্যকীয় অনুসঙ্গ হিসেবে চলে আসছে আবহমান কাল থেকে। ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ আমাদের ঐতিহ্যবাহী পরিচয়। কিন্তু দিনদিন ফুরিয়ে যেতে বসেছে আমাদের মৎস্য সম্পদ। ফুরিয়ে যেতে বসেছে আমাদের ঐতিহ্যবাহী পরিচয়। এক সময় নদীমাতৃক বাংলাদেশের খাল-বিল, হাওড়-বাঁওর, নদী-নালাগুলো ছিল নানা প্রজাতির মাছ। অফুরন্ত মাছের ভাণ্ডার হিসেবে খ্যাত নওগাঁর বদলগাছী খাল বিল সহ নদী-নালা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে দেশি প্রজাতির অনেক মাছ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে দিন দিন মাছের চাহিদা বাড়লেও ক্রমেই কমে আসছে মাছের যোগান। ফলে বাজারে দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়ছে দেশীয় প্রজাতির স্বাদু পানির মাছ। অন্যদিকে, বংশ পরম্পরায় মাছ শিকারের ওপর নির্ভরশীল মৎস্যজীবীরা প্রয়োজনীয় মৎস্য আহরণ করতে না পারায় বাধ্য হচ্ছেন মানবেতর জীবন যাপনে।
দেশে ২৭০ প্রজাতির মিঠা পানির মাছ পাওয়া যায়। এর মধ্যে জাতিসংঘের আইএসপিএন -এর হিসেব মতে, ৫৪ প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত প্রায়। অথচ বিলুপ্ত মাছগুলো এক সময় দেশের বিশাল হাওড়াঞ্চলসহ খাল-বিলে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য মাছ হল : চিতল, টাকি, ফলি, এলং, বাউশ, টাটকিনি, খোকশা, কালা বাটা, নান্দিনা, ঘোড়া খুইখ্যা, সরপুঁটি, বোল, দারকিনা, মহাশোল, রাণী, আইড়, রিটা, মধু পাবদা, কাজলি, বাচা, শিলং, পাঙ্গাস, বাঘাইড়, সিসর, চেকা, গাং মাগুর, কুচিয়া, চান্দা, ভেদা, নাপিত কৈ, পিপলা শোল, তারাবাইম, শালবাইম, তেলো টাকি ইত্যাদি।
কৃষি জমিতে যত্রতত্র ও মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার মৎস্য সম্পদ বিলুপ্তির অন্যতম কারণ। এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি বছর যে বিপুল পরিমাণে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা হয় তার সিংহভাগ জলাশয়ে পতিত হয়। এসব বিষাক্ত রাসায়নিক যৌগ মাছের অনুকূল পরিবেশ নষ্ট করে ফেলে। ফলে মাছ বাঁচতে পারে না বা বংশ বৃদ্ধি করতে পারে না। এছাড়া জলাশয় ভরাট, অবাধে ডিমঅলা ও পোনা মাছ নিধন, অভয়াশ্রম না থাকা, প্যানকালচার ইউনিটের আওতায় মাছ চাষ করতে গিয়ে নদী ও খাল-বিলে বাঁধ দিয়ে দেশীয় প্রজাতির মাছের অবাধ বিচরণে বাধা সৃষ্টি, কারেন্ট জালের অবাধ ব্যবহার ইত্যাদি।
বিলুপ্তপ্রায় মাছের প্রজাতি রক্ষায় সচেতন মহল মনে করছেন,যে হারে দেশি প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হচ্ছে, সে ধারা অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে দেশের নদ-নদীতে মাছের আকাল পড়বে। এমন একটি সময় আসবে যখন দেশি মাছ আর পাওয়াই যাবে না।
বিলুপ্তপ্রায় মাছের প্রজাতি রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ মধ্যে অন্যতম হল অভয়াশ্রম তৈরি করা। বাংলাদেশে উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছের সংরক্ষণের মূল বিষয়টি হচ্ছে শুকনো মৌসুমে যখন খালে-বিলে, নদীতে পানির পরিমাণ কমে যায় সে সময় দেশীয় মাছগুলোকে রক্ষার ব্যবস্থা করা। এই উদ্দেশ্যকে সামনে নিয়ে বেশ কিছুদিন থেকেই সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে দেশের বিভিন্ন নদী ও বিলে মাছের জন্য স্থায়ী অভয়াশ্রম করা হয়েছে।
নওগাঁর বদলগাছীতে মাছ সংরক্ষনের জন্য এরই মধ্য অভয়াশ্রমের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ উপজেলা মৎস্য অধিদপ্তর। বদলগাছীর ছোট যমুনা নদীতে সরকারি ভাবে ২টি অভয়াশ্রম রয়েছে।. আব্দুস সালাম গত ৬/১/২১ তারিখে বদলগাছী যোগদান করেন। এরপর থেকে নিজ উদ্যোগে উপজেলা ছেলাকালি দহৃ ও ডাংঙ্গীসাড়া মৌজার দূর্গা দহে মাছ সংরক্ষণ ও বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকারি অর্থায়নে দুটি অভয়াশ্রম গড়ে তুলেছেন তিনি। সেখানে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ সংরক্ষণ অবাধ বিচরণ, প্রজনন ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের কাজ করছে উপজেলা এই মৎস্য কর্মকর্তা।বদলগাছীর ছোট যমুনায় অভয়াশ্রমে নিরাপদ আবাস্থলে মাছেরা বেঁধেছে সংসার।
তিনি জানান, আগামীতে আরও একটি অভয়াশ্রম যুক্ত করা হবে। বর্তমানে যে দুটি অভয়াশ্রম আছে সেখানে বোয়াল, আইড়, বাতাসি, ট্যাংরা, পাবদাসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আব্দুস সালাম বলেন, অভয়াশ্রমে পানির নিচে বালুর বস্তা তারকাঁটা দিয়ে আটকনো আছে, যাতে কেউ জাল দিয়ে যেন মাছ শিকার করতে না পারে। তাছাড়া বিভিন্ন গাছের ডালপালা রয়েছে।