বিশ্ব প্রতারণা সম্মেলন হচ্ছে। পৃথিবীর সর্বকালের সেরা প্রতারণার তালিকা করা হয় এখানে। প্রতিবছর তালিকা নবায়ন করা হয়। এই তালিকায় বাংলাদেশের নাম আসে না। কী দুঃখের কথা!
এই বদনাম ঘোচাতে এবার আমরা নিজেরা হাজির হয়েছি! আমরা পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন বানিয়ে এনেছি। এবার আমাদের প্রতারণাকে পৃথিবীর সর্বকালের সেরা প্রতারণার তালিকায় রাখতেই হবে। আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আছে ভারত। আছে চীন। ফলে এশিয়া কোটাতেও ভালো প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হচ্ছি আমরা।
ভারতে কী ঘটেছে?
গুজরাটে নর্মদা নদীর ধারে সরদার বল্লভভাই প্যাটেলের উঁচু ভাস্কর্যটাকে নিলামে তুলেছেন একজন ভারতীয়। তিনি অনলাইনে বিজ্ঞাপন দিয়েছেন, ‘করোনা মহামারি মোকাবিলায় হাসপাতাল বানাতে হবে। মেলা টাকা দরকার। এ জন্য এই মূর্তিটা বিক্রি করা হবে। দাম ত্রিশ হাজার কোটি রুপি।’
আমরা বললাম, ‘খুব ভালো প্রতারণাচেষ্টা। কিন্তু সে তো বিক্রি করতে পারেনি। পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছে। আর এই ধরনের ঘটনা তো আজই প্রথম ঘটছে না। ফলে এই প্রতারণায় সৃজনশীলতার অভাব রয়েছে।’
ভারতীয় প্রতিনিধি বললেন, ‘সেটা কী রকম?’
আমাদের স্মার্টফোনে গুগল করে আমরা সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলাম, ‘১৯২৫ সালে কাউন্ট ভিক্টোর লাস্টিগ পুরো আইফেল টাওয়ার বিক্রি করে দিয়েছিল। একবার নয়। বেচেছিল দুইবার। সে গিয়ে একজন লোহালক্কড়ের কারবারিকে বুঝিয়েছিল, আইফেল টাওয়ার ভেঙে পড়ে যাচ্ছে। তার আগেই এটা ভেঙে ফেলতে হবে। এই লোহালক্কড় নিলামে তুলতে হবে। তখন নিলামের ব্যবস্থা হলো। ৩৫ কোটি ডলার দাম উঠল। এরপর একই আইফেল টাওয়ার সে আরেকজন ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে। কাজেই সরদার প্যাটেলের মূর্তি বিক্রি করার চেষ্টা করে জনৈক ভারতীয় এমন কোনো মহান প্রতারণার প্রতিভা দেখাতে পারেননি!’
এরপর উঠলেন চীনের প্রতিনিধি। তাঁরা বললেন, ‘আমাদের ওখানে একটা ওয়েবসাইট খোলা হয়। নাম হলো চান্দ্র দূতাবাস, লুনার এমবাসি। তারা চাঁদে জমি বিক্রি করতে শুরু করে। তাদের দাবি হলো তারা ২৫ বছর ধরে চাঁদের জমি কেনাবেচার কাজ করে আসছে। মাত্র ৯৫ ডলার দিলে চাঁদে এক একর জমি রেজিস্ট্রি করে দেওয়া হয়। অফার আরও আছে। এক হাজার ডলার দিলে পুরো একটা গ্রাম দিয়ে দেওয়া হবে।’
এবার ভারতীয়রা উঠলেন। তাঁরা বললেন, ‘এই কাজ বহু আগে থেকেই হয়ে আসছে। ২০০৪ সালে লাস ভেগাস থেকেও একই প্রতারণার জন্য লিসা ফুরকারসন নামে এক মহিলাকে গ্রেপ্তার করা হয়। বহু বছর ধরেই চাঁদে জমি বিক্রির প্রতারণা এখানে-ওখানে ঘটছে। এতে নতুনত্ব নেই।’
এবার উঠলাম আমরা। আমরা বললাম, ‘আমাদের কেস একেবারেই নতুন। এবং তার সঙ্গে যুক্ত করোনাভাইরাস আর কোভিড-১৯। বাংলাদেশে একটা ক্লিনিক সরকারের কাছে আবেদন করে, তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে রোগীর নমুনা সংগ্রহ করবে; তা পৌঁছে দেবে ল্যাবরেটরিতে। এরপর ল্যাবরেটরিতে টেস্ট হবে। টেস্টের রেজাল্ট তারা জানিয়ে দেবে রোগী বা তার পরিবারকে। সরকার সরল বিশ্বাসে তাদের অনুমতি দেয়। তারা প্রতিদিন ৩০০–৪০০ নমুনা সংগ্রহ করে। প্রত্যেকের কাছ থেকে পাঁচ হাজার থেকে আট হাজার টাকা নেয়। তারপর নমুনাগুলো এক দম্পতি ফেলে দেয়। তারপর নকল লেটারহেড প্যাডে রিপোর্ট বানায়। ইচ্ছা হলে লেখে পজিটিভ। ইচ্ছা হলে লেখে নেগেটিভ। প্রতিদিন তারা ১৫ লাখ থেকে ২০ লাখ টাকা আয় করে। পুরোটাই প্রতারণা। কিন্তু বিজ্ঞ প্রতারণাবিদগণ, আপনারা দেখুন, একেকটা পরিবারে কী দুর্ভোগ তারা নামায়। যার হয়তো করোনা ছিল না, তাকে তারা দিচ্ছে করোনা পজিটিভ। পুরো পরিবার কাঁদছে। হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ফিরছে। আর যার পজিটিভ, তাকে তারা দিচ্ছে নেগেটিভ। সেই রোগী তখন সবার সঙ্গে মিশছে। শিশুর সঙ্গে, বৃদ্ধের সঙ্গে। সে হয়তো বিনা চিকিৎসায় বা ভুল চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে। আর সঙ্গে সঙ্গে সংক্রমিত করছে কতজনকে! এর চেয়ে প্রাণঘাতী প্রতারণা পৃথিবীতে আর কেউ কোনো দিনও কি করেছে?’
সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল। শেষে একজন উঠে বলল, ‘আমরা বিশ্বাস করি না। পৃথিবীর কোনো মানুষ এই প্রতারণা করতে পারে?’
আমরা তখন তাদেরকে দিলাম প্রথম আলোর খবরের লিংক, ‘পরীক্ষা ছাড়াই করোনা শনাক্তের অভিযোগ, জেকেজির সিইও গ্রেপ্তার।’
ফোন করলে বাসায় গিয়ে করোনাভাইরাসের নমুনা সংগ্রহ করা হতো। বিনিময়ে নেওয়া হতো সর্বনিম্ন ৫ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৮ হাজার ৬০০ টাকা। কিন্তু সেই নমুনার কোনো পরীক্ষা ছাড়া এক দিন পরেই পরীক্ষার ফল দেওয়া হতো। এমন অভিযোগ উঠেছে জোবেদা খাতুন সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার (জেকেজি হেলথ কেয়ার) বিরুদ্ধে।…
তেজগাঁও অঞ্চলের সহকারী কমিশনার মো. মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, বিনা মূল্যে কার্যক্রম শুরু করলেও একপর্যায়ে জেকেজি অর্থের সংকুলান করতে পারছিল না। তখন তারা বুকিং বিডি ও হেলথ কেয়ার নামে আরও দুটি প্ল্যাটফর্ম চালু করে। এ দুটি প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে অর্থের বিনিময়ে বাসায় গিয়ে নমুনা সংগ্রহের কাজ শুরু করে তারা। মাহমুদ বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার হুমায়ুন ও তানজীনা বলেছেন, সংগৃহীত নমুনা তাঁরা ফেলে দিতেন। এরপর নিজেদের ইচ্ছা অনুযায়ী প্যাডে ফল লিখে তা মেইল করে পাঠিয়ে দিতেন।’ প্রথম আলো ডট কম, ২৩ জুন।
সম্মেলন মিলনায়তনে নেমে আসে নীরবতা। সবাই স্তব্ধ। প্যানডেমিকের এই সময়ে এই ধরনের প্রতারণা কেউ করতে পারে?
লেখকঃআনিসুল হক,প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক।