সিদ্দিক মাহমুদুর রহমান,
আমার প্রিয় দুলাভাই (ভগ্নিপতি) বাংলাদেশের সাবেক এটর্নি জেনারেল, বিশিষ্ট আইনবিদ, আইন বিশেষজ্ঞ, কিংবদন্তিতুল্য ব্যক্তিত্ব ব্যারিস্টার রফিক-উল হক রাজধানীর আদ-দ্বীন হাসপাতালে আজ (২৪ অক্টোবর ২০২০) ভোরে ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন)।
দেশ, জাতি ও শত শত ব্যক্তি মানুষের জন্য তাঁর অবদান বলে শেষ করা যাবে না। আমি অত্যন্ত মর্মাহত, ব্যাথিত, বেদনার্ত।
ব্যারিস্টার রফিক-উল হক চলে গেলেন। কত শত স্মৃতি এসে ভর করছে মনের পর্দায়! কলকাতায় যখন থাকতাম, তখন ওদের বিয়ে হলো, রফিক ভাই আর হেনা আপার। সেটা সম্ভবত ১৯৫৫-৫৬ সালের কথা।
রফিক ভাই তখন সবে ‘ল’ পাস করেছেন আর হেনা আপা ডাক্তারী পড়ছেন। ওরা কলকাতায় এসে ওদের বালু হক্কক লেনের দোতলা বাড়িটাতে এসে উঠলেন। থাকা ওখানে আর খাওয়া ৮বি তারক দত্ত রোডে, আমাদের বাসায়।
আহ, কি মজা হতো সে সময়! হেনা আপা, মনে হয় বিশ্বের সবচেয়ে সুধাময়ী নারী। আর দুলাভাই অত্যন্ত প্রাণবন্ত, উজ্জ্বল যুবক। হেনা আপা, মানে ড. ফরিদা হক, বাংলাদেশে মাইক্রোবায়োলজি বিদ্যার একজন শীর্ষ ব্যক্তিত্ব। আমার দুধ বোন। শিশুকালে আমার মায়ের দুধ খেয়েছিলেন তিনি। সে কারণে কি না জানি না, হেনা আপা আর রফিক ভাই আমাকে অত্যন্ত ভালবাসতেন। পরে অনেক দিনের ফারাক।
আমরা যখন যশোরে, ১৯৬৫ সাল থেকে। ওরা প্রায়ই আসতেন বেড়াতে। ১৯৬৯ সালে আমি যখন বিএ পাশ করলাম, তিনি বললেন, ঢাকায় চল, তোকে চাকরি দিয়ে দেই। মা বললেন, না, বড় আপা মাস্টার্স, বড় ভাই মাস্টার্স, ও মাস্টার্স না করে চাকরী করবে না।
আমার ভাগ্যটা নিতান্ত খারাপ ছিলো তার পর বাধলো মুক্তিযুদ্ধ, পারিবারিক জটিলতা। পুরো দশ বছর পর মাস্টার্স পাশ করে ঢাকায় গেলাম।
দুলাভাই বললেন, ‘ধন্য তোর অধ্যাবসায়। মাস্টার্স করলি তবে ছাড়লি।’
তারপর তিনি আমাকে ঢুকিয়ে দিলেন প্রথমে এডরুক কোম্পানীতে, তারপর তিন বছর পর বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি – বারডেমে যোগ দিলাম আমি!
তারপর ইতিহাস! আমাদের আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে কতো ছেলে-মেয়ের যে চাকরী দিয়ে দিয়েছেন রফিক দুলাভাই, গুণে শেষ করতে পারবো না।
তাঁর কাছে কেউ গেলেই হলো। কোন না কোন জায়গায় ঠিক গুঁজে দিতেন। এতো প্রতিষ্ঠানের সাথে তাঁর পরিচয়, ঘনিষ্টতা! এতো মানুষ তাকে ভালোবাসতো, শ্রদ্ধা করতো!
ভারতের লেখক শংকর এসেছিলেন একটা বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে। রফিক ভাই আমাকে ফোন করে বললেন।‘তুই চলে আয় ঢাকা ক্লাবে। আমি লক্ষ করলাম শংকরের সঙ্গে রফিক ভাইয়ের ভীষণ ঘনিষ্টতা। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি বাংলাদেশে আর উনি ভারতে আপনাদের এই সম্পর্ক কীভাবে হলো? রফিক ভাই বললেন, তোর তো জানার কথা। আমি তো কলকাতা ইউনিভার্সিটির ছাত্র না? আমরা সে সময়ে একসঙ্গে ভারতীয় যুব কংগ্রেস করতাম।
রফিক ভাইয়ের জন্ম কলকাতায়। বেড়ে উঠেছেন সেখানে। কলকাতা হাইকোর্ট দিয়ে শুরু তার পেশাজীবন। আর আমরা আমার আব্বার চাকুরী সূত্রে (আব্বা কলকাতায় পাকিস্তান ডেপুটি হাই কমিশন অফিসের ভিসা বিভাগের কর্মকর্তা। ভারতের বহু রথি-মহারথিদের পাসপোর্টের ভিসা সিলে তাঁর হাতের সই আছে!) সে অবশ্য ১৯৫৪-১৯৬৫ সালের কথা।
তিনি বিশেষভাবে আলোচিত ওয়ান ইলেভেনের সময় দুই নেত্রীর মামলা পরিচালনা করে। দুই নেত্রীর রাজনৈতিক সংকটে তিনি আইনি ঐক্যের প্রতীক ছিলেন।
এমন একদিন তিনি আমাকে বলেছিলেন, জানিস, আমি ভাবছি দুই ম্যাডামকে আমার বাড়িতে এনে একটা ঘরে বন্ধ করে দিয়ে বলবো, দেশের প্রশ্নে আপনারা একমত না হওয়া পর্যন্ত দরজা খুলবো না।‘
তারপর বিমর্ষ হয়ে বলেছিলেন, ‘জানিস, সমস্যা ওদের মধ্যে না, আমি বললেই ওরা এক মত হবেন, আমার কথায় না করতে পারবেন না, কিন্তু সমস্যা নিচেরগুলোকে নিয়ে!’
খুব ব্যস্ত থাকতেন, তার মধ্যেও মাঝে মাঝে আমার সাথে অনেক আলাপ করতেন। আমাকে বলেছিলেন, ‘তোর বাপ খুব সৎ মানুষ ছিলো, তাই তোকে বারডেমের এমন জায়গায় দিলাম, লাখ লাখ টাকা উড়বে, মাথা ঠিক রাখিস।’
আমি ২০০৩ সালে বারডেম থেকে যখন বেরিয়ে আসি, সে দিন তাঁর সাথে করিডোরে দেখা। আমি বলেছিলাম, ‘আমি কথা রেখেছি দুলাভাই। এই বিশ বছরে আমার চারটা এপার্টমেন্ট হতো ঢাকায়। আমি আজও ভাড়া বাসায় থাকি।‘ তিনি আমার পিঠে হাত দিয়ে বলেছিলেন, ‘তাই তো তোকে এতো ভালবাসি।‘
বাংলাদেশ সরকারের চরম দৈন্যতা ব্যারিস্টার রফিক-উল হক-কে রাষ্ট্রীয় সম্মান ‘একুশে পদক’ বা ‘স্বাধীনতা পদক’ না দেওয়া। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক যে আইনী সহায়তা দান করেন, তার কি কোন তুলনা হয়?
এবার হয় তো তাঁকে ‘মরনোত্তর’ পদক দিয়ে ধন্য হবেন সরকার।
তাতে প্রয়াত ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের কি কোন লাভ হবে?
আমার সারা জীবনে তারা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই আমার গাইডিং এঞ্জেল ছিলেন। আমি আমার সবচেয়ে পরম আত্মীয়কে হারালাম!