ভোটকেন্দ্রের চারশ গজের মধ্যে চিৎকার, চেঁচামেচি করলে বা ভোটাররা বিরক্ত হন এমন কোনো শব্দ সৃষ্টি করলে খাটতে হবে দুই বছরের জেল। ভোটের প্রয়োজনে নিয়োগ করা যাবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাইরেও ‘অন্য কোনো আইন প্রয়োগকারী সংস্থা’। এছাড়া পরিষদের মেয়াদ শেষ হলেও থাকা যাবে স্বীয় পদে।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোর আইন সংশোধন করে এমন বিধান আনছে নির্বাচন কমিশন।
বর্তমানে ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ ও সিটি করপোরেশন এই পাঁচ ধরনের স্থানীয় সরকার নির্বাচন পরিচালনার জন্য পাঁচটি পৃথক আইন ব্যবহার করা হচ্ছে। এ সবগুলোকে একটি আইনের ভেতরে আনার জন্য নতুন একটি আইন করছে নির্বাচন কমিশন। প্রস্তাবিত ওই আইনটির নাম দেওয়া হয়েছে- স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান আইন-২০২০। যা সকল স্থানীয় সরকার নির্বাচনের জন্য প্রযোজ্য হবে।
এতে আগের মতোই অধিকাংশ বিষয় রাখা হলেও, বেশকিছু নতুন বিষয় যুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রস্তাবিত আইনের খসড়ায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে- বাংলাদেশ পুলিশ, র্যাপিড অ্যাকশান ব্যাটালিয়ন (র্যাব), বাংলাদেশ আনসার, গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী, বর্ডার গার্ডস অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড এবং অন্য কোনো আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। এখানে ‘অন্য কোনো আইন প্রয়োগকারী সংস্থা’ শব্দগুলো নতুন এসেছে।
আগে নির্বাচন কমিশনের আইনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনীকেও রাখা হয়েছিল। পরে সেটা সংশোধন করে সশস্ত্র বাহিনীকে বাদ দেওয়া হয়।তবে এবার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী না বলে ‘আইন প্রয়োগকারী সংস্থা’ নিয়ে আসতে চায় ইসি।
স্থানীয় সরকারগুলোর নাম ও পদবি পরিবর্তন
নতুন প্রস্তাবিত আইনে সিটি করপোরেশনকে মহানগর সভা, পৌরসভাকে নগর সভা ও ইউনিয়ন পরিষদকে পল্লী পরিষদ করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এতে সিটি মেয়রের পদকে- মহানগর আধিকারিক; পৌর মেয়রকে পুরাধ্যক্ষ বা নগরপিতা, কাউন্সিলরকে পরিষদ সদস্য, ওয়ার্ডকে মহল্লা, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানকে উপজেলা পরিষদের প্রধান, উপ-প্রধান এবং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানকে পল্লী পরিষদ প্রধান করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
পরিষদের মেয়াদ
কোনো প্রতিষ্ঠান গঠন হওয়ার পর থেকে তার মেয়াদ ধরা হয়েছে প্রথম সভা থেকে পরের পাঁচ বছর। তবে মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও নির্বাচিত নতুন প্রতিষ্ঠান প্রথম সভায় মিলিত না হওয়া পর্যন্ত পূর্ববর্তী প্রতিষ্ঠানের সদস্যরা তাদের কাজ চালিয়ে যাবেন। বর্তমান আইন অনুযায়ী, মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আর দায়িত্ব পালনের কোনো সুযোগ নেই।
প্রার্থিতার যোগ্যতা
যে কোনো স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে প্রার্থী হতে হলে অবশ্যই বয়স হতে হবে ২৫ বছর এবং বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে। থাকতে হবে নির্বাচনী এলাকার ভোটার লিস্টে নাম।
অনৈতিক কার্যকলাপ ও শাস্তি
কোনো প্রার্থী সম্পর্কে অপপ্রচার, প্রার্থীর প্রার্থিতা প্রত্যাহার নিয়ে মিথ্যা প্রচার, সাম্প্রদায়িক বা সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে অপ্রপ্রচার ও ভোট প্রদানে বাধা দিলে ন্যূনতম ছয় মাস এবং সর্বোচ্চ দুই বছরের সাজা।
জোরপূর্বক ভোট প্রদান ও শাস্তি
ভোটকেন্দ্র থেকে কোনো প্রার্থী বা তার প্রতিনিধিকে বিতাড়ন এবং তাদের অনুপস্থিতিতে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাকে ভোট পরিচালনায় বাধ্য করলে, কর্মকর্তাদের বের করে দিয়ে ভোটের উপকরণ দখল এবং ইচ্ছানুযায়ী ব্যবহার করলে, কাউকে ভোটদানে বিরত রেখে কেবল নিজের পছন্দের প্রার্থীর সমর্থকদের ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিলে ছয় মাস থেকে সাত বছরের কারাদণ্ড।
অর্থের বিনিময়ে কোনো সুবিধা দেওয়ার মাধ্যমে কাউকে ভোট দেওয়া থেকে বিরত রাখা, কাউকে ভোট দেওয়া বা কাউকে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করালে দুই বছরের কারাদণ্ড। কোনো ব্যক্তির নামে ভোট প্রদান, কাল্পনিক নাম ধারণ করে ভোট প্রদান বা মৃত ব্যক্তির ভোট দিলে ছয় বছরের কারাদণ্ড।
অবৈধ প্রভাব বিস্তার
কোনো শক্তি প্রদর্শন, ত্রাস সৃষ্টি, ভীতি প্রদর্শন, আঘাত-ক্ষতি-সম্মানহানী ঘটালে, কোনো সাধু বা পীরের অভিশাপ কামনা করার ভীতি প্রদর্শন করলে, ধর্মীয় দণ্ড প্রদান বা প্রদান করার ভীতি দেখালে এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা বা প্রভাব খাটালে দুই বছরের কারাদণ্ড। এছাড়া দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার কারণে এক বছর, সরকারি পদের অপব্যবহারের কারণে পাঁচ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
সভা, সমাবেশ, শোভাযাত্রা ও মিছিল
ভোটগ্রহণ শুরুর আগের ৩২ ঘণ্টা থেকে ভোটগ্রহণ শেষের ৬৪ ঘণ্টা পর্যন্ত নির্বাচনী এলাকায় কোনো ব্যক্তি কোনো জনসভা আহ্বান, অনুষ্ঠান বা তাতে যোগদান করতে এবং কোনো মিছিল বা শোভাযাত্রা সংঘঠিত করতে বা তাতে যোগদান করতে পারবে না। এছাড়া এই সময়ের মধ্যে কোনো আক্রমণাত্মক কাজ বা বিশৃঙ্খলামূলক আচরণ করতে পারবেন না। ভোটার বা নির্বাচনে নিয়োজিত কোনো ব্যক্তিকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করতে পারবেন না। কোনো অস্ত্র বা শক্তিও প্রদর্শন করা যাবে না। এই বিধান না মানলে সর্বোচ্চ সাত বছরের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
ভোটকেন্দ্রের চারশ গজের মধ্যে কার্যকলাপ
কোনো ব্যক্তি ভোটগ্রহণের দিন ভোটকেন্দ্রের চারশ গজের মধ্যে ভোটের প্রচার চালালে, কারো কাছে ভোট চাইলে, কাউকে ভোট না দিতে দিলে দুই বছরের কারাদণ্ড। এছাড়া ভোটগ্রহণের দিন ভোটকেন্দ্র থেকে শোনা যায় এমনভাবে চিৎকার করলে বা এমন কোনো কাজ যা ভোটারদের বিরক্তি সৃষ্টি করে বা ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের কাজে ব্যঘাত ঘটায় এবং ভোটকেন্দ্র থেকে শোনা যায় এমন কোনো মাইক্রোফোন, লাউড স্পিকার বা প্রতিধ্বনি সৃষ্টিকারী যন্ত্র ব্যবহারেও দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে।
ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা
রিটার্নিং অফিসারকে বাংলায় রূপান্তর করে ‘নির্বাচন অধিকর্তা’ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এক্ষেত্রে উপজেলা, জেলা, আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা বা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিকে নির্বাচন অধিকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেবে ইসি।
নির্বাচনের সময়
কোনো প্রতিষ্ঠান (স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান) গঠন হলে তার পরের ১৮০ দিনের মধ্যে ভোটগ্রহণ করতে হবে। আর পরবর্তী কালে মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পূর্ববর্তী ১৮০ দিনের মধ্যে ভোটগ্রহণ করতে হবে। আর বিলুপ্ত হলে সে সময় থেকে পরের ১৮০ দিনের মধ্যে ভোটের বিধান রাখা হয়েছে। তবে যে কোনো পরিস্থিতিতে দৈবদুর্বিপাক হলে নির্বাচন কমিশন তার সুবিধামতো সময়ে ভোট করবে।
এ বিষয়ে ইসি সচিব মো. আলমগীর বলেন, সবগুলো প্রতিষ্ঠানের আইনকে আমরা একটি আইনে রূপান্তর করতে চাচ্ছি। এছাড়া এটা বাংলায় করা হচ্ছে। এজন্য কিছু নাম ও পদবির পরিবর্তনের প্রস্তাবও রাখা হয়েছে। বড় কোনো পরিবর্তনের প্রস্তাব নেই। তবে এই প্রস্তাবের ওপর আমরা রাজনৈতিক দলসহ সবার মতামত নেবো। সবার মতামতের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বিডি-প্রতিদিন