২৫ জুন ফোন আসে গুলশান থেকে। একজন নারী ফোন করেছেন সাহায্য চেয়ে। মরদেহ দাফন করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবী দল পাঠানো হয়। দলটি গিয়ে দেখে, মরদেহ থেকে গন্ধ ছড়াচ্ছে। উদ্ধারে সহায়তা নেওয়া হয় স্থানীয় পুলিশের।
এমনই এক অভিজ্ঞতার কথা প্রথম আলোকে জানান সালেহ আহমেদ। তিনি কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের হয়ে মরদেহ দাফন ও সৎকারের কাজটি সমন্বয় করছেন। তিনি জানান, তিন দিন ধরে চেষ্টা করেও কোনো সাহায্য পাননি বয়স্কা নারী। নিজে বিয়ে করেননি, পরিবারে অন্ধ ছোট ভাই আর বৃদ্ধ বাবা। মৃত বাবার মরদেহ নিয়ে দুই ভাইবোন পার করেছেন তিন দিন। একপর্যায়ে কোয়ান্টামের নম্বর পেয়ে সেখানে ফোন করেন।
করোনাকালে দাফন বা সৎকারে এগিয়ে আসা প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, এমন একটি বা দুটি নয়, অনেক ঘটনা জমা হচ্ছে। এসব ঘটনা এখন স্বেচ্ছাসেবীদের নিত্যদিনের সঙ্গী। করোনা সংক্রমণের আতঙ্ক যখন পরিবারকে দূরে ঠেলে দেয়, পড়শিদের স্বার্থপর করে তোলে, আত্মীয় হয়ে যায় পর, তখন মানবিক সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। যাদের হয়ে কাজ করছেন শত শত স্বেচ্ছাসেবী।
মানবতার হাত ধরে গত ৩০ জুন পর্যন্ত সারা দেশে দাফন ও সৎকার হয়েছে ৩ হাজার ১৩৯টি মরদেহ। সাতটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা মিলে এসব দাফন ও সৎকার করেছে। এর বাইরে সারা দেশে ছোট ছোট উদ্যোগে আরও অনেক দাফন ও সৎকার কার্যক্রম চলছে।
করোনায় মৃত ব্যক্তিদের দাফন বা সৎকারে সহায়তা ও তদারকি করতে ফোকাল পারসন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. সাইফুল্লাহিল আজম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, করোনায় মারা গেলেও মানুষ যেন তাঁর শেষ সময়ে সেবা পায়, এটা নিশ্চিত করতেই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোকে নিয়ে কাজ করছে সরকার। কাউকে কোনোভাবেই হয়রানি করা যাবে না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, ৩০ জুন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১ হাজার ৮৪৭ জন। করোনার উপসর্গ বা লক্ষণ নিয়ে মৃত্যুর তথ্য দেয় না সরকারের এই অধিদপ্তর। তবে ২৭ জুন পর্যন্ত করোনার উপসর্গ নিয়ে দেড় হাজার মৃত্যুর তথ্য পেয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ (সিজিএস)। এর আগে ৬ জুন পর্যন্ত সারা দেশে খোঁজ নিয়ে করোনার উপসর্গে ৮৬৪ জনের মৃত্যুর তথ্য পায় প্রথম আলো।
ঢাকায় নগদ সহায়তা বন্ধ
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত সংস্থা হিসেবে কাজ করছে আল মারকাজুল ইসলামী, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন, রহমতে আলম ফাউন্ডেশন ও আল রশীদ ফাউন্ডেশন। এর বাইরে সরকারি অনুমোদন না পেলেও দাফন ও সৎকারের কাজ করছে কয়েকটি সংস্থা। এসব সংস্থার বাইরে ব্যক্তি উদোগেও অনেকে এগিয়ে এসেছেন। চট্টগ্রামে কাজ করছে আল মানাহিল ফাউন্ডেশন। রাজনৈতিক দলের মধ্যে ইসলামী আন্দোলন কাজ করছে। এর বাইরে আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের নেতারাও বিভিন্ন এলাকায় দাফন ও সৎকারে সহায়তা দিচ্ছেন।
ঢাকার অনুমোদিত চার সংস্থা বলছে, ঢাকায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে ফোন করে তাদের মৃত ব্যক্তির খোঁজ জানানো হয়। করোনায় আক্রান্ত বা করোনা সন্দেহে যাঁদের মৃত্যু হয়েছে, তাঁদের মরদেহ দাফন ও সৎকারের জন্যই তাদের ডাকা হয়। সরকারের পক্ষ থেকে সুরক্ষাসামগ্রী দেওয়া হয়। এর বাইরে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে প্রতিটি মরদেহ দাফন বা সৎকারে নগদ সহায়তা দেওয়া হতো শুরুর দিকে। শুধু করোনা শনাক্ত হয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তির ক্ষেত্রে এ সহায়তা দেওয়া হতো। ঢাকায় নতুন দুই মেয়র দায়িত্ব নেওয়ার পর এটি বন্ধ আছে। এ সহায়তা আবার চালু করার দাবি জানিয়েছে তারা।
কোন সংস্থার কতগুলো দাফন ও সৎকার
এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি দাফন ও সৎকার করেছে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন। জুন পর্যন্ত ৯৫২টি মরদেহ দাফন ও সৎকার করেছে কোয়ান্টাম। এর মধ্যে ৮০৭টি ইসলাম ধর্মের রীতি মেনে দাফন করা হয়েছে। বাকিগুলোর মধ্যে সনাতন ধর্মের ১৩৩, বৌদ্ধ ৯ ও খ্রিষ্টধর্মের ৩ জনের মরদেহ সৎকার করেছে সংস্থাটি।
সালেহ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, বিধি মেনে ৭০০ স্বেচ্ছাসেবী কাজ করছেন সারা দেশে। প্রতিদিন গড়ে ৩০টি দাফন বা সৎকার করছেন তাঁরা।
করোনাকালে প্রথম এগিয়ে আসে আল মারকাজুল ইসলামী। করোনায় আক্রান্ত বা উপসর্গ নিয়ে মৃত ৯০৬ জনকে দাফন ও সৎকার করেছে তারা। এর বাইরে করোনাকালে আরও ১ হাজার ৮০০ মরদেহের গোসল ও অন্যান্য প্রস্তুতির কাজটি করে দিয়েছে সংস্থাটি। এটি মূলত মুসলিমদের জন্য হলেও এখন অন্য ধর্মের মানুষের মরদেহও সৎকার করছে।
সংস্থাটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হামজা শহীদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মরদেহ গ্রামে নিয়ে নিজেরা কবর খুঁড়ে দাফন করেছেন স্বেচ্ছাসেবীরা, এমন ঘটনাও আছে।
আগের অভিজ্ঞতা না থাকলেও এপ্রিলে মাঠে নামে রহমতে আলম সমাজসেবা সংস্থা ও আল রশীদ ফাউন্ডেশন। রহমতে আলমের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এবং সাবেক জেলা ও দায়রা জজ মো. আতাউর রহমান বলেন, জুন পর্যন্ত ২১৩টি মরদেহ দাফন ও সৎকার করেছেন তাঁরা।
হজ এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (হাব) সভাপতি এম শাহাদাত হোসাইন তসলিম এগিয়ে আসেন তাঁর প্রতিষ্ঠিত আল রশীদ ফাউন্ডেশন নিয়ে। জুন পর্যন্ত ২৫৬টি মরদেহ দাফন ও সৎকার করেছেন তাঁরা।
প্রশাসন ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সহযোগিতা নিয়ে জুন পর্যন্ত করোনা–সম্পর্কিত ২৭৫টি মরদেহ দাফন ও সৎকার করেছে আল মানাহিল। এ সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ফরিদ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, মানবিকতা সবার আগে।
ব্যক্তি উদ্যোগে এগিয়ে আসাদের মধ্যে অন্যতম হলেন নারায়ণগঞ্জের কাউন্সিলর মাকসুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ। ৬১টি মরদেহ দাফন বা সৎকারের পর স্ত্রীসহ করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। তিনি হাসপাতালে থাকলেও কাজ চালিয়ে গেছেন তাঁর স্বেচ্ছাসেবীরা। নিজে সুস্থ হয়ে আবার মাঠে নেমেছেন। জুন পর্যন্ত ৯১টি মরদেহ দাফন ও সৎকার করেছেন তিনি। এর মধ্যে ৮২টি করোনা–সম্পর্কিত। মাকসুদুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, দাফন ও সৎকারের পাশাপাশি বিনা পয়সায় অক্সিজেন সরবরাহ ও প্লাজমা দানে সহায়তা করছেন তিনি।
মরদেহ পড়ে থাকার সংবাদ দেখতে দেখতে মাঠে নামে রাজনৈতিক দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। জুন পর্যন্ত ৪৪৬টি মরদেহ দাফন ও সৎকার করেছেন সংগঠনের কর্মীরা। ছোট পরিসরে হলেও ঢাকায় কাজ করছে মাস্তুল ও পাথওয়ে ফাউন্ডেশন নামের দুটি সংস্থা। জুন পর্যন্ত পাথওয়ে ২৮টি ও মাস্তুল ১৭টি মরদেহ দাফন করেছে।
পুরান ঢাকার বাসিন্দা সমীর ধর জানান, ‘চার দিন আগে-পরে তাঁর বাবা ও মা মারা যান। করোনা না হলেও কেউ এগিয়ে আসেনি। কোয়ান্টাম না এলে হয়তো তাঁদের দাহ করাতে পারতাম না।’
এই সাতটি সংস্থার নেতৃত্বদানকারী সবাই প্রথম আলোকে বলছেন, তাঁরা যে কাজ করছেন, তা মানবতার জন্য, এখানে বাণিজ্যিক কোনো দৃষ্টিভঙ্গি নেই।
সূত্রঃ প্রথম আলো