রাবি প্রতিনিধি
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) আয়ের গুরত্বপূর্ণ উৎস কৃষি প্রকল্প। আনুমানিক ১৯৭৩ বা ‘৭৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০ থেকে ২৫০ বিঘার অধিক জমিতে ফসল উৎপাদন শুরু হয়। এছাড়াও পুকুরগুলো লিজ দেওয়ার পাশাপাশি পশু পালনও করা হয়। এই প্রকল্প থেকে গত ১০ বছরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আয় করেছে প্রায় দেড় কোটিরও অধিক টাকা এবং ভুয়া হিসাব নাম্বার দেখিয়ে ১৫ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেছে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ১০ বছরে কৃষি প্রকল্পে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সর্বমোট ৯ কোটি ৭৩ লক্ষ ৪ হাজার ৯৫০ টাকা আয় করেছে। এর বিপরীতে ব্যয় হয়েছে ৮ কোটি ১৬ লক্ষ ৯৯ হাজার ৭৪৮ টাকা।
আয়-ব্যয়ের অর্থবছরগুলোতে দেখা যায়, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে আয়ের পরিমাণ ৪৬ লক্ষ ৮৫ হাজার ৮৩৩ টাকা, বিপরীতে ব্যয় হয় ২৫ লক্ষ ৪৮ হাজার ৪৬৭টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে আয়ের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৭২ লক্ষ ৩৪ হাজার ৪৯০টাকায় যার বিপরীতে ব্যয় হয় ২৯ লক্ষ ২৪ হাজার ৮৫৪ টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আয়ের পরিমাণ বিগত বছরের দ্বিগুণ হয়ে ১ কোটি ৩৭ লক্ষ ৯১ হাজার ৬৬ টাকা হয় এবং ব্যয় হয় ১ কোটি ১০ লক্ষ ৭১ হাজার ৫৬৫ টাকা।
২০১৬-১৭ অর্থবছরে আয়-ব্যয় দুটোই হ্রাস পায়। এবছরে আয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ৬১ লক্ষ ৮০ হাজার ৯৮ টাকা যার বিপরীতে ব্যয় হয় ৬২ লক্ষ ৭৬ হাজার ৪৬৮ টাকা। অর্থাৎ, এ বছর কিছুটা লস হয়৷ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তার পরিমাণ পুনরায় বৃদ্ধি পেয়ে আয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ৭৪ লক্ষ ৮৬ হাজার ৩৯০ টাকায় যার বিপরীতে ব্যয় হয় ৩৬ লক্ষ ৯০ হাজার ২২৮ টাকা। পরবর্তী অর্থবছরে আয় হয়েছে ৩৬ লক্ষ ৯০ হাজার ২২৮ টাকা। পরবর্তী অর্থবছরে আয় -ব্যয়ের পরিমাণ ১ কোটি ১ লক্ষ ৯ হাজার ৫২৩ টাকা এবং ব্যয়ের পরিমাণ ৬৪ লক্ষ ১৯ হাজার ১৯৬ টাকা। যা ২০১৯-২০ অর্থবছরে আয়ের পরিমাণ অর্ধেক হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় ৫৭ লক্ষ ৮৭ হাজার ৮৭০ টাকায় এবং ব্যয় হয় ৪২ লক্ষ ৮৬ হাজার ৯০৬ টাকা৷ ২০২০-২১ ও ২০২১-২০২২ অর্থবছরে আয়ের পরিমাণ যথাক্রমে ৭২ লক্ষ ৫১ হাজার ২৬৩ ও ৬৩ লক্ষ ৬১ হাজার ৪১৫ টাকা এবং ব্যয়ের পরিমাণ যথাক্রমে ৭৪ লক্ষ ৪৭ হাজার ৬০০ টাকা ও ৮৮ লক্ষ ৭ হাজার ৫২৩ টাকা।
সর্বশেষ ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে আয়-ব্যয়ের পরিমাণ সর্বাধিক হয়ে প্রায় ৩ কোটিতে রূপ নেয়।এই বছর সর্বমোট আয়ের পরিমাণ ২ কোটি ৮৪ লক্ষ ১৭ হাজার ২ টাকা এবং ব্যয়ের পরিমাণ ২ কোটি ৮২ লক্ষ ২৬ হাজার ২৮০ টাকা।
২০১৭ সালে তৎকালীন হিসাব পরিচালক, কোষাধ্যক্ষ ও উপ-পরিচালক (হিসাব) এর স্বাক্ষরিত অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপক বরাবর পাঠানো এক চিঠিতে দেখা গিয়েছে ‘মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র’ নামে ০২০০০০৯৫০১৫৭৩ হিসাব নাম্বারে টাকা স্থানান্তরের কথা বলা হয়েছে। চিঠিতে টাকার পরিমাণ ১৫ লক্ষের কথা উল্লেখ থাকলেও এরচেয়ে বেশি টাকাও আত্মসাৎ এর অভিযোগ রয়েছে৷ চিঠিতে মেমো নং হিসাব/৭৯০(৬) উল্লেখ করা হয়েছে।
কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র’ নামে কোনো কেন্দ্র নেই। বর্তমান এই হিসাব নাম্বার খোঁজ করা হলে তা অকার্যকর দেখাচ্ছে। কৃষি প্রকল্পের অগ্রণী ব্যাংকের হিসাব নং-৩৪০১৪২১৯ থেকে এই টাকা স্থানান্তরিত হয়েছে।
টাকা স্থানান্তরের বিষয়ে কৃষি প্রকল্পের দপ্তর সহকারী রেজিস্ট্রার মনোয়ার হোসেন বলেন, প্রশাসনের নির্দেশেই টাকা স্থানান্তরের ঘটনা ঘটেছে৷ আমার মনে হয় ১৫ থেকে ২০ লক্ষ টাকা স্থানান্তরিত হয়েছে।
কাগজের বিষয়ে তিনি বলেন, এই মুহূর্তে আমাদের কাছে কোনো কাগজ নাই। খোঁজ করলে হয়তো পেতে পারি৷
এবিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীবের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, বিষয়টি আমার নজরে এসেছে৷ বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই আমরা আলোচনায় বসেছি। ঘটনা খতিয়ে দেখতে একটা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি ইতিমধ্যেই কাজ শুরু করে দিয়েছে ।
উল্লেখ্য, কৃষি প্রকল্পের ব্যয়ের খাতসমূহগুলো দেখানো হয়েছে শ্রমিক মজুরী, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কল্যাণে অনুদানসহ কোভিড-১৯ এর জন্য অনুদান প্রদান । ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের বিশেষ (চিকিৎসা) অনুদান, কোভিড-১৯ এর অনুদান, কৃষি প্রকল্পের কৃষি যন্ত্রাংশ ক্রয় ও মেরামত, ডিজেল,মবিল, সার, কীটনাশক, সুগারমিল, রাজশাহীর ঋণ পরিশোধ (প্লাউ সার কীটনাশক), মেডিকেল সেন্টারের এক্স-রে মেশিন।
এছাড়াও কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে বঙ্গবন্ধু কর্ণার, জোহা চত্বর, ঢাকাস্থ গেস্ট হাউস ক্রয়ে অর্থ প্রদান, বরেন্দ্র জাদুঘরের আসবাবপত্র তৈরি, বিভিন্ন বাগান তৈরি, বৃক্ষ রোপণ, উপাচার্য, উপ-উপাচার্যদ্বয়ের বাসভবনের বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ ও টব ক্রয়, প্রশাসন ভবনের ভিতরে বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ রোপণের জন্য ড্রাম ও টব ক্রয় করা হয়। মেইন গেইট ডিভাইডার ফুলের বাগানের ফুল গাছ লাগানো ও পরিচর্যাসহ খরচ।
ব্যয়ের খাতগুলোতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, পরিবহণ কর্মচারী ক্লাব ও সহায়ক কর্মচারী ক্লাবে টিভি ক্রয়ে অনুদান, স্বেচ্ছায় রক্ত দাতা সংগঠন বাঁধন রাবি শাখার জন্য ফ্রিজ ক্রয়ে অনুদান প্রদান। সাত পুকুর গবেষণা ও সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্পে অর্থ প্রদান, মজুর প্রনোদনা ঈদ উৎসব, বি.এ.ডি.সি হতে বিভিন্ন ফসলের বীজ ক্রয়, ক্লিনিং চার্জ, FDR তৈরি ইত্যাদি কাজে কৃষি প্রকল্পের তহবিল ব্যবহৃত হয়।
হাফিজুর রহমান
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়