মুজাহিদ হোসেন, জেলা প্রতিনিধি নওগাঁঃ
নওগাঁর বদলগাছী উপজেলার বিলাশবাড়ী ইউনিয়নের ”হলুদ বিহার” গ্রামের দ্বীপগঞ্জ নামক স্থানে এ বিহারটি অবস্থিত। রাজশাহীর ইতিহাস ( কাজী মেসের)- এর তথ্য মতে, এটি পাহাড়পুরের সমসাময়িক একটি বৌদ্ধ বিহার। এটিও অন্তত হাজার বছরের প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমান হলুদ বিহার গ্রাম তথা দ্বীপগঞ্জ পুরুটাই প্রাচীন জনপদের ধ্বংসাবশেষের ওপর অবস্থিত বলে অনুমান করা যায়। এই গ্রামের সবখানেই প্রাচীন ইট, নকশা করা ইট, পোড়া মাটির চিত্রফলকের টুকরা, কোনো কোনো স্থানে প্রাচীন দালানের ভিত্তি চিহ্ন চোখে পরবে।
ভারতের প্রত্নতত্ত্ব জরিপ বিভাগের জি.সি দত্ত ১৯৩০-৩১ সালে স্থানটি পরিদর্শন করেন। লক্ষ করেন যে, এটি পূর্ব-পশ্চিমে ৬৪.৫ মিটার এবং উত্তর-দক্ষিণে ৪০.৫ মিটার এবং সংলগ্ন ভূমি হতে এর উচ্চতা প্রায় ১০.৫ মিটার। ইট খুলে নেয়ার ফলে আংশিকভাবে এটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলে প্রাচীন নির্মাণাদি এবং আঁধা ফোটা পদ্মের উপর মহারাজলীলাভঙ্গিতে বসা চারবাহু বিশিষ্ট একটি ক্ষুদ্র (১ মিটার উঁচু) ব্রোঞ্জ নির্মিত গণেশ মূর্তি উন্মোচিত হয়। এটিকে আট-নয় শতকের বলে শনাক্ত করেন। ১৯৬৩ সালে কাজী মেসের এ অঞ্চল পরিদর্শন করে পাথরের একটি ভগ্ন বৌদ্ধমূর্তি ও পাহাড়পুররীতির কয়েকটি পোড়ামাটির ফলক উদ্ধার করেন। বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের হারুনুর রশীদ ১৯৭৪ সালে এ এলাকাটি পরিদর্শন করেন এবং দেখতে পান যে, সমগ্র এলাকা, বিশেষকরে হলুদ বিহার গ্রামের দক্ষিণপূর্ব দিকে এক বিশাল পুরানো দিঘির চারপাশে অসংখ্য নিচু টিবি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এ ঢিবিগুলির অধিকাংশকেই সমান করা হয়েছে এবং চাষাবাদের আওতায় আনা হয়েছে। পুরানো ইট এবং পোড়ামাটির ফলকের ভগ্নাংশ সমগ্র এলাকায় বিক্ষিপ্ত অবস্থায় রয়েছে। বিশাল দালানের ভিত্তির নিদর্শন এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট উদ্ধারকৃত প্রাচীন নিদর্শনাদি হলুদ বিহার গ্রামের মাটির নিচে একটি সমৃদ্ধশালী বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বের পক্ষে যথার্থ সাক্ষ্য প্রদান করে। নিকটবর্তী একটি বাড়িতে পাহাড়পুর রীতির কয়েকটি পোড়ামাটির ফলক ও পাথরের ভাস্কর্য দেখতে পাওয়া যায়।বিহারটি নওগাঁ জেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ (পনেরো) কি.মি. পশ্চিম- উত্তরে, বদলগাছী উপজেলা সদর হতে ১১ (এগারো) কি.মি. পূর্ব-দক্ষিণে এবং ঐতিহাসিক পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার থেকে প্রায় ১৭ কি.মি. দক্ষিণে অবস্থিত। বিহারটি এক নজর দেখার জন্য প্রতিদিনই দেশের ভেতরের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ছাড়াও বিদেশী পর্যটকরা ভ্রমণ করেন। তথ্য সংগ্রহ কালে, এলাকার বেশ কিছু স্থানীয়বাসিন্দাদের সঙ্গে কথোপকথনে নানা তথ্য উঠে আসে। তারা বলেন, বিকেল ছাড়া সকাল থেকে বিকেল এর পূর্ব পর্য ন্ত কোনো পর্যটক ভ্রমণে আসিলে প্রচন্ড ক্লান্ত হয়ে পড়ে। সেখানে বিশ্রামের নির্দিষ্ট কোনো জায়গা না থাকায় ততক্ষণিক তাদের ভ্রমণ সমাপ্ত করে স্থান ত্যাগ করতে হয়। কর্তৃপক্ষের নজরদারি ঢিলেঢালা থাকায় যেকেউ সুযোগ পেলেই সেখানের যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা ফেলা ছাড়াও মলমূত্র ত্যাগ করে স্থানটির আশেপাশে নোংরা করে। যা পরিবেশকে দূষিত করে। বিহারটি সম্পূর্ণ উন্মুক্ত ও সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ না করার কারণে জনসাধারণের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত ক্ষতি সাধিত হচ্ছে যা চলতে থাকলে অচিরেই তা ধ্বংস প্রাপ্ত হবে। ইতিপূর্বে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের বিভিন্ন কর্মকর্তা স্থানটি পরিদর্শন করলেও বিহারটির সংস্কার বা যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। সর্বশেষ ২৪ শে অক্টোবর ২০২০ খ্রিঃ হলুদ বিহার ও জগদ্দল বিহারকে ইউনেস্কোর হেরিটেজ সাইটের তালিকাভুক্ত করার লক্ষ্যে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সম্মানিত মহাপরিচালক ও সরকারের অতিরিক্ত সচিব জনাব হান্নান মিয়া সহ ততকালীন বদলগাছী উপজেলা ইউনো জনাব আবু তাহির স্থানটি পরিদর্শন করেন। এলাকাবাসীর দাবী বিহারটি ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা , সংস্কার ও বিশ্রামের জন্য অতিদ্রুত প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।